বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বাড়াচ্ছে পাশবিক নির্যাতন

ধর্ষণ একটি ক্ষমার অযোগ্য জঘন্যতম অপরাধ- যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এটি শুধু শারীরিক নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একজন ভুক্তভোগীর মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে।

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

ভূঁইয়া শফি
ধর্ষণ একটি অসামাজিক ও শাস্তিযোগ্য নিকৃষ্ট অপরাধ- যা সমাজে নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে হুমকিতে ফেলে দেয়। সামাজে নারীর প্রতি বৈষম্য, আইনের দুর্বলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বাড়াচ্ছে ধর্ষণের সংখ্যা। এই ঘৃণ্য অপরাধের ফলে একজন ভুক্তভোগীর জীবনে চরম মানসিক আঘাত, সামাজিক অবহেলা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। তাই ধর্ষণের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। ধর্ষণের প্রধান কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজের অনেক ক্ষেত্রে এখনো নারীদের অবমূল্যায়ন করা হয় এবং তাদের অধিকার খর্ব করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। লিঙ্গ বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা অনেক সময় নারীদের দুর্বল ও অধীনস্থ করে রাখার চেষ্টা করে। যা ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করতে পারে। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা, আইনের ফাঁকফোকর এবং 'বিচারহীনতার সংস্কৃতি'ও ধর্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। যখন অপরাধীরা অপকর্ম করে শাস্তি এড়াতে পারে আবার অন্যদিকে, দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার কারণে বিচারের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যায়। তখনই এই ভয়ংকর ও নিকৃষ্ট অপরাধের প্রবণতা বাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- অশ্লীলতা ও অপরাধমূলক সংস্কৃতি। বিকৃত রুচি ও বিকৃত মানসিকতার কিছু মানুষ চলচ্চিত্র, শর্টফিল্ম, নাটক, বিজ্ঞাপন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের ভোগ্যপণ্য এবং নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে??। এতে সমাজে নারীদের প্রতি অসম্মানজনক মনোভাব গড়ে ওঠে। যা অনেক ক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাদকাসক্ত তরুণরা মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এতে তাদের মাঝে বিকৃত মানসিকতার সৃষ্টি হয়। এই বিকৃত মানসিকতার কারণেও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয় তারা। বিশেষ করে, মদ, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন ও অন্যান্য উত্তেজক মাদকের প্রভাব মানুষকে আক্রমণাত্মক ও হিংস্র করে তুলতে পারে। মাদকের সহজলভ্যতা এবং সমাজে মাদকের বিস্তার ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের হার বাড়িয়ে তুলছে। গত ২১ ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গণমাধ্যমে ওঠে আসা তথ্যে, ১৪ থেকে ২১ ফেব্রম্নয়ারি ৭ দিনে নারী ও শিশুসহ চারজন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত বছরে (২০২৪ সালে) সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণপরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। আসকের পক্ষ থেকে বিগত বছরের ৩১ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন পাঠানো হয়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যের বরাতে বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিক বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তথ্যটি বিশ্লেষণ করে পত্রিকাটি বলছে, 'গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেই দেখা যায় গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত দুজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন'। ইংরেজি জাতীয় দৈনিকটির দাবি, 'ধর্ষণের ঘটনার এক তৃতীয়াংশেরই মামলা হয় না। গণমাধ্যমে আসা ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১৯টির। যার অর্থ ধর্ষণের ঘটনার তিনটির মধ্যে কমপক্ষে একটি ঘটনার কখনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয়নি'। মামলা বা অভিযোগ দায়ের করে ভোক্তভোগী ন্যায়বিচার পাবে তা অনিশ্চিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত ধীরগতি ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা টাকার অভাবেও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ধর্ষণের মামলার বিচারহীনতা ও বিচারে ধীর গতি আমাদের সমাজের একটি গুরুতর সমস্যা। মামলা দায়েরের পর প্রভাবশালী অপরাধীদের প্রভাব, সামাজিক চাপ ও ভুক্তভোগীর প্রতি অবিচারের মনোভাব বিচার প্রক্রিয়াকে ধীরগতি করে তোলে। অনেক সময় প্রমাণের অভাবে কিংবা দুর্বল তদন্তের ফলে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং ন্যায়বিচারের আশাও হারিয়ে ফেলে। ধর্ষণ একটি ক্ষমার অযোগ্য জঘন্যতম অপরাধ। যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এটি শুধু শারীরিক নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একজন ভুক্তভোগীর মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি মানসিকভাবে তিনি ভয়, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং আতঙ্কজনিত মানসিক ব্যাধিতে ভুগতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (চঞঝউ)-এ আক্রান্ত হন। যা তার দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি আজীবন মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক হেয় প্রতিপন্নতার শিকার হন- যা তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। অনেকে আত্মহত্যার মতো চরম পথও বেছে নেন। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীর পরিবার ও সমাজিক জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ধর্ষণের ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। যদি ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে এবং সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। আইনব্যবস্থার দুর্বলতা ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধের পুনরাবৃত্তিকে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে, কঠোর আইন ও দ্রম্নত বিচারব্যবস্থার অভাব থাকায় ভুক্তভোগীরা বিচার পেতেও নিরুৎসাহিত হন। ধর্ষণ প্রতিরোধে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য। সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। সমাজে নারীদের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। যাতে তারা স্বাধীনভাবে এবং নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারেন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সম্মানজনক অবস্থান গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে। সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্টায় যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নৈতিক শিক্ষার প্রসার, শিশুদের মানবিকমূল্যবোধ শেখানো এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যাতে অপরাধীরা দ্রম্নততম সময়ে বিচারের সম্মুখীন হয়। তাই দ্রম্নত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করতে হবে সেই সঙ্গে প্রভাবমুক্ত তদন্ত এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে তারা সাহস নিয়ে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে পারে। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাস্তাঘাট, গণপরিবহণ ও কর্মস্থলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, ভুক্তভোগীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এবং মানসিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ালেই হবে না- বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করলে একটি নিরাপদ ও মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব হবে। যেখানে নারীরা ভয় ও সহিংসতার ঊর্ধ্বে থেকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে। ভূঁইয়া শফি : কলাম লেখক