কৃষির ডিজিটাল বিপস্নব উন্নয়ন বিভ্রান্তি নাকি করপোরেট নিয়ন্ত্রণ?

সরকারের উচিত প্রযুক্তির পাশাপাশি বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করা, যাতে কৃষকরাই প্রকৃতপক্ষে লাভবান হন। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানো, কৃষকদের জন্য সহজলভ্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ চালু করা এবং কৃষি ঋণ ও ভর্তুকি বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত ডিজিটাল বিপস্নব।

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

মোছা. রোকেয়া সুলতানা
বাংলাদেশের কৃষি খাতে 'ডিজিটাল বিপস্নব' এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। সরকারের উদ্যোগে মোবাইল অ্যাপ, ই-কমার্স পস্ন্যাটফর্ম, কৃষি তথ্যসেবা ও ভর্তুকির সুবিধা চালু করা হয়েছে। ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তবে, বাস্তবতা কী বলছে? এ প্রযুক্তির সুফল কি কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে, নাকি এটি কেবল করপোরেট লভ্যাংশ বৃদ্ধির নতুন মাধ্যম হয়ে উঠছে? বাংলাদেশের কৃষি খাতে দীর্ঘদিন ধরেই উন্নয়ন চেষ্টা চলছে। কৃষি খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখা গেছে- যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কৃষি তথ্যসেবা ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মে আনা। কিন্তু এই 'ডিজিটাল বিপস্নব' কৃষকদের জন্য কতটা কার্যকরী, সেই প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষক এখনো প্রচলিত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ কৃষকের হাতে স্মার্টফোন নেই, আর গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ এখনো দুর্বল। তাই ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মগুলো আসলে কার জন্য? কৃষকদের জন্য, নাকি মধ্যস্বত্বভোগী ও করপোরেট ব্যবসায়ীদের জন্য? অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, 'উন্নয়ন তখনই সফল হয়, যখন তা সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে।' তাহলে প্রশ্ন উঠছে, এই ডিজিটাল বিপস্নব কৃষকদের ক্ষমতায়ন করছে, নাকি তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে? বর্তমানে কৃষিপণ্য অনলাইনে বিক্রির সুযোগ থাকলেও এর বাস্তবায়নে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ডিজিটাল মার্কেটপেস্নসের সুবিধা এলে কতজন কৃষক নিতে পারছেন? শহরের মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পস্ন্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন, অথচ কৃষকরা সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না। কৃষকদের জন্য এমন পরিস্থিতি একেবারে নতুন নয়, ১৯৯৬ সালে কৃষি ঋণ বিতরণের শুরুর পর থেকেই তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে পড়ে যায়। তবে, নরম্যান বোরলগ বলেছিলেন, 'এৎববহ জবাড়ষঁঃরড়হ যধং ষরভঃবফ সরষষরড়হং ভৎড়স যঁহমবৎ, নঁঃ :যব হবীঃ ৎবাড়ষঁঃরড়হ সঁংঃ বসঢ়ড়বিৎ :যব ভধৎসবৎ.' ডিজিটাল বিপস্নব কি কৃষকদের সত্যিকারের ক্ষমতায়ন ঘটাচ্ছে? সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকি ও সহজ শর্তে কৃষি ঋণ দিচ্ছে, তবে বাস্তবে এসব সুযোগ কতটা তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে? তথ্য বলছে, বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক লবিগুলো সহজেই এসব সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষকরা নানান জটিলতার কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে, ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা আসলে কার জন্য কার্যকর? কৃষকরা ব্যাংকিং জটিলতার কারণে সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারছেন না। অথচ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই কৃষি ঋণ সংগ্রহ করছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে এই ডিজিটাল রূপান্তর কি কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখছে, নাকি এটি শুধু বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা নিশ্চিত করছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, কৃষি খাতে প্রাপ্ত ঋণের ৬০ শতাংশ যায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। তাহলে কৃষকরা এর থেকে কতটা লাভবান হচ্ছেন? বাংলাদেশের কৃষি খাত দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য তারা কম দামে কিনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। ডিজিটাল বিপস্নবের ফলে কি এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে? ২০১৬ সালে ভারতে চালু হওয়া 'ব-ঘঅগ' (ঘধঃরড়হধষ অমৎরপঁষঃঁৎব গধৎশবঃ) প্রকল্প কৃষকদের ডিজিটাল বিপণনের সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু সেখানে ক্ষুদ্র কৃষকদের অংশগ্রহণ এখনো কম। এতে প্রমাণিত হয়, ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মের সুবিধা লাভে কৃষকদের অংশগ্রহণের সুযোগ এখনো যথেষ্ট নয়। ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মে কৃষকরা সরাসরি ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব পস্ন্যাটফর্মের নিয়ন্ত্রণও করপোরেট কোম্পানির হাতে। ফলে, কৃষকরা এখানে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন, আর লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে কৃষি খাতে প্রায় ৪৮ শতাংশ বাজার মূল্য মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে চলে যায়। এসব অবস্থা প্রযুক্তির ব্যবহারকে সঠিক পথে চালিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার অভাবই বুঝিয়ে দেয়। কৃষকদের মূল সমস্যাগুলো হলো ন্যায্যমূল্যের অভাব, পানি সেচ সমস্যা, বীজ ও সার সংকট এবং বাজার ব্যবস্থায় অসঙ্গতি। ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা কি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে? যদি কৃষকরা মূল উপকরণ ও পরিষেবাগুলোর ডিজিটাল সুবিধা না পান, তবে ডিজিটাল বিপস্নব তাদের কতটুকু সাহায্য করবে? সরকার ডিজিটাল কৃষির প্রচারণা চালালেও, মাঠপর্যায়ে কৃষকদের বাস্তব সমস্যার সঠিক সমাধান হচ্ছে না। প্রযুক্তি যদি কৃষকদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই 'ডিজিটাল বিপস্নব' শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে। অথচ ডিজিটাল কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউনাইটেড নেশনস ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ঋঅঙ) বলেছে, 'কৃষির ডিজিটাল রূপান্তর সফল হতে হলে, প্রথমেই কৃষকের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে।' তবে ডিজিটাল প্রযুক্তি পুরোপুরি অকার্যকর বলার সুযোগ নেই। কৃষকদের হাতে যদি স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সাক্ষরতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তারা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় এগিয়ে যেতে পারবেন। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, 'প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষিতে যদি সঠিকভাবে হয়, তাহলে কৃষকদের উৎপাদনশীলতা ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।' সরকারের উচিত প্রযুক্তির পাশাপাশি বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করা, যাতে কৃষকরাই প্রকৃতপক্ষে লাভবান হন। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানো, কৃষকদের জন্য সহজলভ্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ চালু করা এবং কৃষি ঋণ ও ভর্তুকি বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত ডিজিটাল বিপস্নব। কৃষির ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অনেক। এটি যদি কৃষকদের সত্যিকারের সুবিধা দিতে না পারে, তবে এটি কেবল করপোরেট নিয়ন্ত্রণের নতুন রূপ হবে। প্রযুক্তির সুফল পেতে হলে প্রথমে কৃষকের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। নয়ত এই ডিজিটাল বিপস্নব কৃষকের জন্য নয়, বরং করপোরেট স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবেই বিবেচিত হবে। মোছা. রোকেয়া সুলতানা : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ