বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

আমরা কি অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছি?

অ্যাসিড সন্ত্রাস রোধে কঠোর আইন থাকলেও, তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই মামলা হলেও সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিতে জটিলতা-দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে মামলাগুলো সঠিক সময়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে না কিংবা কাঙ্ক্ষিত রায় পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্তি না হওয়ায় অ্যাসিড সন্ত্রাসীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে আর ভুক্তভোগীরা সুবিচার না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছেন!
আসিফ আল মাহমুদ
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আমরা কি অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছি?
আমরা কি অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছি?

অ্যাসিড সন্ত্রাস রোধে সরকার কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি গঠন করেছিল বিশেষ তদারকি সেল। ফলশ্রম্নতিতে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে দেশে অ্যাসিড নিক্ষেপের হার বর্তমানে অনেকটাই কমে এসেছে। আর এই কাজে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে 'অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন (এএসএফ)'-এর মতো বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা।

বছর কয়েক আগেও খবরের কাগজ খুললেই দেখা যেত, অ্যাসিড নিক্ষেপের ভয়াবহ সব ঘটনা। দু-একটি নয়, রীতিমতো অজস্র অ্যাসিড হামলার ঘটনায় ঠাসা থাকত সংবাদপত্রগুলো। নব্বই দশক থেকে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৯৯ সালে অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৬৮টি। ২০০২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৬, যা দেশের ইতিহাসে ছিল সর্বোচ্চ! তারপর বাধ্য হয়েই অ্যাসিড সন্ত্রাস দমনে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে। অ্যাসিড সন্ত্রাসীর সর্বোচ্চ শাস্তি 'ফাঁসি' নির্ধারণ করা হয়। কেবল সরকার নয়, অনেক বেসরকারি সংস্থাও এই অপরাধ মোকাবিলায় সমান তালে কাজ করে গেছে। বছরে তিন থেকে ৪শ' অ্যাসিডদগ্ধ হওয়ার ঘটনা আজ অনেকাংশেই কমে এসেছে, যা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি সুখকর অর্জন। তবে এখনো রয়ে গেছে চ্যালেঞ্জ।

২০০২ সালে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নাড়া দিয়েছিল গোটা দেশকে! তথ্য-উপাত্ত জানাচ্ছে, ২০০২ থেকে ২০১১ সাল অবধি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা উলেস্নখযোগ্য হারে কমেছে। ২০০২ সালে ৪৯৪টি ঘটনার পর ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯১টিতে।

অপরাধের সাজা কার্যকর হওয়ার নজির কম থাকলেও তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত গণমাধ্যমে এর ব্যাপক প্রচারের দরুন মানুষের মধ্যে অ্যাসিড হামলার বিষয়ে এক প্রকার ভীতি তৈরি হয়েছে। তাছাড়া অ্যাসিড বেচাকেনা ও পরিবহণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন হওয়ায়, সেটিও পরোক্ষভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে অ্যাসিড সন্ত্রাস নির্মূল করার সাফল্য ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য সন্দেহাতীতভাবে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে।

২০০২ সালে আইন হওয়ার পূর্বে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগত প্রায় ১০-১২ বছর! সেখানে আইন হওয়ার পর তা মাত্র ০৪ মাসে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়। তবে যখনই কোনো মামলা উচ্চ আদালতে চলে যায়, তখনই এর গতি পুনরায় ধীর হয়ে যায়। অল্প কিছু মামলার রায় তুলনামূলক দ্রম্নত পাওয়া গেলেও, বাদবাকিগুলো আইনের দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে অযথা দিনের পর দিন আটকে থাকে।

নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি অনলাইন পত্রিকা বাংলাদেশের অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ে ২০১১ সালে এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে মোট দুই হাজার ১৬৯টি মামলা দায়ের হয়েছে। 'অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন (এএসএফ)' বলছে, মাত্র ১৯৯টি মামলায় সন্দেহভাজনদের দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে। প্রমাণের অভাবে অন্তত এক হাজার ৯৫০ জন সন্দেহভাজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আইন তৈরির পর ৯৫ শতাংশের বেশি অ্যাসিড হামলার ঘটনায় মামলা হলেও রায়ের হার ছিল ১০ শতাংশেরও নিচে। তাছাড়া আপিলের সুযোগ থাকায় মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে যেত। অ্যাসিড হামলার ঘটনায় আজ পর্যন্ত কোনো ফাঁসির রায় হওয়ার নজির নেই।

বেসরকারি সংস্থা 'এএসএফ' আরও বলছে, উচ্চ আদালত ও বিচারিক আদালত মিলিয়ে অ্যাসিড সহিংসতার প্রায় ৬০০ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, শতকরা ৩০ ভাগ অ্যাসিড নিক্ষেপকারী দোষী প্রমাণিত হলেও উচ্চ আদালতে তাদের আপিলের কারণে দন্ড স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে আনুমানিক ৩০০টি মামলা নিম্নআদালতে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাসিড সন্ত্রাস রোধে কঠোর আইন থাকলেও, তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই মামলা হলেও সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিতে জটিলতা-দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে মামলাগুলো সঠিক সময়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে না কিংবা কাঙ্ক্ষিত রায় পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্তি না হওয়ায় অ্যাসিড সন্ত্রাসীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে আর ভুক্তভোগীরা সুবিচার না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছেন!

আসিফ আল মাহমুদ : ফ্রিল্যান্স রাইটার, নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে