জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত একটি সমস্যা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর আবহাওয়া দ্রম্নত পরিবর্তিত হচ্ছে, যার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ গলে উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া, খরা, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে পুরো বিশ্ব। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি এক বিশেষ সংকটে রূপ নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, বিশেষ করে কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, যানবাহন, বন উজাড়, কৃষি ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। ভৌগোলিক অবস্থান, উচ্চ জনঘনত্ব এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে। দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের রিপোর্ট অনুযায়ী, যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পায়, তাহলে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
তাছাড়া বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকির মুখে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১.৩ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হতে পারে (ডড়ৎষফ ইধহশ, ২০২১)। এই গবেষণা প্রতিবেদনগুলো অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার একটি চিত্র তুলে ধরেছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত একটি নিম্নাঞ্চলীয় দেশ। দেশের প্রায় ৮০% এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ মিটারের কম উচ্চতায় অবস্থিত, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং নিম্নাঞ্চলীয় ভূমির কারণে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিতে অবস্থান করছে। আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৭% এলাকা তলিয়ে যেতে পারে, যার ফলে ১.৫ কোটি মানুষ বাস্তুচু্যত হবে। উপকূলীয় জেলাগুলো (সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা) ইতিমধ্যে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ এবং জমির উর্বরতা হ্রাসের সম্মুখীন। তাছাড়া গত দুই দশকে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা উলেস্নখযোগ্যহারে বেড়েছে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে ৩,৫০০ জনের মৃতু্য এবং ২০২০ সালের আম্ফানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় বন্যা প্রতিবছরই ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। বাংলাদেশের ৩৫০টিরও বেশি নদী প্রতি বছর গড়ে ১০,০০০ হেক্টর জমি ভেঙে নিয়ে যায় (তথ্যসূত্র :পানি উন্নয়ন বোর্ড), যার ফলে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ বাস্তুহারা হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশ খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তাহীনতা এবং জীববৈচিত্র হ্রাসের ঝুঁকিতে ভুগছে। লবণাক্ত পানি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ধান ও সবজি চাষকে ব্যাহত করছে।
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের চাল উৎপাদন ৮% এবং গম উৎপাদন ৩২% কমতে পারে। এতে দেশের এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। যার ফলশ্রম্নতিতে দেশে অনাহার কিংবা দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের বিস্তৃত অঞ্চলে বন্যা এবং ভূমিধসের ঘটনা বাড়ছে, যা প্রাণহানির মত বড় ক্ষতি ঘটাচ্ছে। একটি দেশ ও জাতির অস্তিত্ব যখন প্রকৃতির ক্রমবর্ধমান প্রতিশোধের সামনে দাঁড়িয়ে নতজানু হয়, তখন সেই সংকট আর শুধুমাত্র পরিবেশগত নয়; বরং তা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়। বাংলাদেশ এমন এক ভয়াবহ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দ্রম্নত ব্যবস্থা না নিলে সামনে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, যা পুরো জাতিকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই এই সমস্যা মোকাবেলায় যত দ্রম্নত সম্ভব কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়ন এবং বাঁধ সংস্কার জরুরী। জলবায়ুুর সাথে তাল মিলিয়ে স্মার্ট কৃষির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লবণসহিষ্ণু ধানের জাত (ব্রি ধান-৬৭) এবং ড্রিপ সেচ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ প্রয়োজন। পাশাপাশি ফসলে অভিযোজন কৌশল আয়ত্ত করার নিমিত্তে সরকারকে কৃষির উৎপাদনশীলতা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবীণ কৃষক এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা প্রদান করতে হবে।
এছাড়া, নদী এবং জলাভূমি সংরক্ষণ এবং নদীভাঙন প্রতিরোধে শক্তিশালী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু তহবিল তৈরি করাও আবশ্যক। যাতে এ ধরনের দুর্যোগের পর, ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রম্নত সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু তহবিলের জন্য নির্দিষ্ট অংশীদারিত্ব ও সহায়তা প্রয়োজন, যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন প্রকল্পে সংকট সৃষ্টি না হয়। নিরবচ্ছিন্ন সরকারি নীতিমালা এবং পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আরও পরিবেশগত অবহেলা না হয়। সরকারি বাজেটের একটি বড় অংশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় ব্যয় করা উচিত। জলবায়ু নীতিমালায় তরুণদের পরামর্শক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। স্টার্টআপগুলোর জন্য বিশেষ তহবিল তৈরি এবং অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে গাইডেন্স প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। এই সংকটের মোকাবিলা করতে হলে এককভাবে সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন একটি ঐক্যবদ্ধ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের যে চরম ক্ষতি হচ্ছে সেই বিপদ থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রের কাজের নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাধারণ জনগণ এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সম্মিলিত উদ্যোগ এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই এই ভয়াবহ সমস্যাকে রুখে দেওয়া সম্ভব।
প্রজ্ঞা দাস : শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ