ইগোর কারণে জুলাই বিপস্নব যেন হাতছাড়া না হয়

দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, অগণিত সন্তান পিতৃহারা হয়েছেন, বিধবা হয়েছেন বহু নারী। ১৬ কোটি মানুষের আর্তনাদের ফসল জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপস্নব। রাজনৈতিক দলগুলোর ইগো-জনিত কারণে জুলাই বিপস্নব যেন হাতছাড়া হয়ে না যায় সে ব্যাপারে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দীর্ঘদিনের মিত্রতার সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই সম্পর্কে চরম টানাপড়েনের মধ্যে পড়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় ও এর আগের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণে দুই দলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতির মাত্রা বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, সংস্কারের আগে নির্বাচন নাকি নির্বাচন আগে হবে- এই প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। জুলাই গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এই বিরোধ আরও প্রকট হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, দ্রম্নততম সময়ে নির্বাচন হওয়া উচিত। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, আগে সংস্কার না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এছাড়া, জামায়াতের নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ বিএনপির মধ্যে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, জামায়াতের এই তৎপরতা মূলত বিএনপিকে দুর্বল করার একটি কৌশল। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, তারা কেবল নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল অনুযায়ী এগুচ্ছে। বিরোধের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে জাতীয় বনাম স্থানীয় নির্বাচনের প্রশ্ন। বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচন আগে হোক এবং অন্যান্য নির্বাচন পরে। তবে জামায়াত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি জামায়াত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের এই অবস্থান জানালে বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। বিএনপির ধারণা, জামায়াতের এই অবস্থান মূলত জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার কৌশল। জামায়াতের নেতারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির অংশ হতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে বিরোধী দলের শক্তি বিভক্ত হবে এবং সরকারি দল এর সুবিধা নিজ ঘরে তুলবে। এই পরিস্থিতিতে দুই দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরের প্রতি সন্দেহ পোষণ করছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দলের মধ্যে এই বিরোধের মূল কারণ রাজনৈতিক স্বার্থের পার্থক্য। বিএনপি মনে করছে, জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে ভোট বিভক্ত করতে পারে, যা বিএনপির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অন্যদিকে জামায়াত মনে করছে, নির্বাচনের আগে যথাযথ সংস্কার ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা তাদের নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এই দ্বন্দ্বের আরেকটি কারণ হলো- বিএনপির ওপর জামায়াতের নির্ভরশীলতা কমে আসা। আগে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে মিলে রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করলেও বর্তমানে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বিএনপি এটিকে তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার পরিপন্থি বলে মনে করছে এবং জামায়াতের স্বতন্ত্র উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনে কার বেশি ভূমিকা ছিল- এই প্রশ্নেও দুই দলের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। বিএনপির দাবি, তাদের দীর্ঘ ১৬ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলেই এই পরিবর্তন এসেছে; যেখানে জামায়াত বলছে, বিভিন্ন গণআন্দোলনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। এই কৃতিত্বের লড়াই দুই দলের মধ্যে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ছাত্র আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে দুই দলের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। বিএনপি মনে করছে, এই আন্দোলনের ভিত্তি তাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, যেখানে জামায়াত বলছে, আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল ছাত্র সংগঠনগুলো। এই মতপার্থক্যের কারণে উভয় দলই তাদের সমর্থকদের ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে এবং একে অপরের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা করছে। জামায়াত রাজনৈতিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী করতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছে- যা বিএনপির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিএনপি মনে করছে, এই জোট বিএনপিকে দুর্বল করতে পারে এবং বিরোধী দলের ভোট বিভক্ত করতে পারে। জামায়াত তাদের দলীয় স্বার্থের কথা ভেবেই ধর্মভিত্তিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ করে এক বাক্সে ভোট নেওয়ার লক্ষ্যে এই জোট গঠনের চেষ্টা করছে। বিএনপির উদ্বেগের আরেকটি কারণ, জামায়াতের এই জোট গঠনের প্রচেষ্টা বিএনপির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে দুর্বল করতে পারে। জামায়াত তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শক্তিশালী করতে চাইছে, কিন্তু বিএনপি মনে করছে, এই উদ্যোগ তাদের সমর্থন কমিয়ে দেবে এবং সরকারবিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরাবে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। জাতীয় বনাম স্থানীয় নির্বাচন, গণ-অভু্যত্থানের কৃতিত্ব, রাজনৈতিক সংস্কারের অগ্রাধিকার এবং বিকল্প জোট গঠনের মতো ইসু্য দুই দলের মধ্যে আরও বড় বিভাজনের সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতে এই দ্বন্দ্ব কতটা গভীর হবে, তা নির্ভর করবে তাদের পারস্পরিক সমঝোতা ও রাজনৈতিক কৌশলের ওপর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা, দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, অগণিত সন্তান পিতৃহারা হয়েছেন, বিধবা হয়েছেন বহু নারী। ১৬ কোটি মানুষের আর্তনাদের ফসল জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপস্নব। রাজনৈতিক দলগুলোর ইগো-জনিত কারণে জুলাই বিপস্নব যেন হাতছাড়া হয়ে না যায় সে ব্যাপারে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও কলামিস্ট