বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে স্বপ্নপূরণ নাকি মেধাপাচার?

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা একদিকে স্বপ্নপূরণের সুযোগ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, মেধাপাচারের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি দেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে, যদি আমরা বিদেশফেরত শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি। তবে, যদি অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে থেকে যায়, তাহলে এটি দেশের জন্য একটি বড় ক্ষতি।
জাফরিন সুলতানা
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে স্বপ্নপূরণ নাকি মেধাপাচার?
বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে স্বপ্নপূরণ নাকি মেধাপাচার?

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশগমন দিন দিন বাড়ছে। উন্নতমানের শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ ও ভালো ক্যারিয়ারের আশায় হাজারো ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। তবে, প্রশ্ন থেকে যায়- এটি কি শিক্ষার্থীদের স্বপ্নপূরণের বাস্তবায়ন, নাকি দেশের জন্য মেধাপাচার? একদিকে, শিক্ষার্থীরা উন্নত বিশ্বের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করছে, অন্যদিকে, তাদের অধিকাংশই দেশে ফিরে আসে না- যা দেশের মানবসম্পদের জন্য একটি বড় ক্ষতি।

অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়াকে তাদের স্বপ্নপূরণ হিসেবে দেখে। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা অনেক বেশি- যা বাংলাদেশে এখনো সীমিত। ফলে, যারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ব্যবসা বা অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চায়, তারা উন্নত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য শিক্ষার্থীরা উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণার সুবিধার খোঁজে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষা প্রদান করে- যা বাংলাদেশে এখনো সীমিত। উন্নত বিশ্বে পড়াশোনা করে অনেক শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার বা সরকারি সংস্থায় কাজের সুযোগ পায়। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে বেশি স্থিতিশীল ও বেতনের পরিমাণও বেশি- যা শিক্ষার্থীদের সেখানে থাকার জন্য উৎসাহিত করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য বিদেশে পড়াশোনা একটি বড় সুযোগ। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়- যা তাদের দক্ষতা ও মানসিকতা প্রসারিত করে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থী দেশে ফিরে আসে এবং অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। অনেকেই প্রযুক্তি, ব্যবসা, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য খাতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে- যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশের জন্য এটি একটি উদ্বেগজনক বিষয় যে, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আর দেশে ফিরে আসে না। এটি 'মেধাপাচার' হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে দেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণরা অন্য দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে বাংলাদেশ সরকার প্রচুর বিনিয়োগ করে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বৃত্তির মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বা স্বল্প ব্যয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। কিন্তু তারা যদি বিদেশে থেকে যায়, তাহলে দেশের সেই বিনিয়োগের কোনো প্রত্যাবর্তন হয় না। দেশের উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে থেকে যায়, তখন বাংলাদেশ গবেষণায় পিছিয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোতে গবেষণার ভালো সুযোগ থাকায় আমাদের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে গবেষণায় যুক্ত হয়- যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে দক্ষ, তাদের অনেকেই বিদেশে থেকে যাওয়ায় বাংলাদেশ দক্ষ মানবসম্পদের সংকটে পড়ে। ফলে, দেশে উন্নত মানের শিক্ষিত কর্মীর অভাব দেখা দেয়, যা শিল্প ও প্রযুক্তি খাতকে পিছিয়ে দেয়। যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে থেকে যায়, তারা তাদের শ্রম, মেধা ও অর্থনৈতিক অবদান বিদেশি অর্থনীতিতে দেয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি সেই অবদান থেকে বঞ্চিত হয়- যা দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়া বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়, বরং সরকার ও নীতি নির্ধারকদের উচিত শিক্ষার্থীদের দেশে ফেরানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যদি বাংলাদেশে উন্নত গবেষণাগার, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ভালো শিক্ষকের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে। এছাড়া, দেশে ভালো বেতনের চাকরি, করপোরেট সুবিধা ও গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত করা যায় তাহলে বিদেশফেরত শিক্ষার্থীরা দেশে থাকতে আগ্রহী হবে। যারা বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে আসবে, তাদের জন্য সরকার বিশেষ প্রণোদনা বা সুযোগ দিতে পারে। এতে তাদের দেশে ফিরে আসার আগ্রহ বাড়বে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি গবেষণামুখী হতে হবে, যাতে মেধাবীরা দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী হয়। পাশাপাশি, সরকারকেও বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা একদিকে স্বপ্নপূরণের সুযোগ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, মেধাপাচারের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি দেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে, যদি আমরা বিদেশফেরত শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি। তবে, যদি অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে থেকে যায়, তাহলে এটি দেশের জন্য একটি বড় ক্ষতি। সুতরাং, সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে- যাতে মেধাবীরা দেশে ফিরে আসে এবং দেশের অর্থনীতি, গবেষণা ও প্রযুক্তিতে অবদান রাখতে পারে। শুধু তখনই এটি স্বপ্নপূরণ হিসেবে গণ্য হবে, নতুবা এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি মেধাপাচার হয়ে দাঁড়াবে।

জাফরিন সুলতানা :শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে