১৩ ফেব্রম্নয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস। বেতারে এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ছাত্র-জনতার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা। এ বছর বেতার দিবসের প্রতিপাদ্য-'জধফরড় ধহফ ঈষরসধঃব ঈযধহমব' বা 'বেতার ও জলবায়ু পরিবর্তন'। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিকভাবে ১৪তম বিশ্ব বেতার দিবস পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে। এই উপলক্ষে ১৩ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বেতার প্রধান সদর দপ্তর ঢাকার আগারগাঁও-এ সারাদেশের বেতারপ্রেমী ৬ শতাধিক শ্রোতা নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করছেন। এবারের শ্রোতা সম্মেলন বা বেতার দিবস সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে। কারণ বৈষম্যহীন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ গড়ার মন্ত্রে বেতার শ্রোতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা ২৪-এ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে এবারের আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন। বেতার ভবন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্রে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এবার বিশ্ব বেতার দিবস পালিত হচ্ছে।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী '২৪-এর চেতনা ধারণ করে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও স্বপ্নকে লালন করে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ বেতার। এছাড়াও কমিউনিটি রেডিও এফএম সম্প্রচারের মাধ্যমে স্থানীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং বিনোদনমূলক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে। অ্যাপসের মাধ্যমে সহজেই রেডিও শোনা যাচ্ছে বলে এর শ্রোতা দিন দিন বাড়ছে। সকালে আবহাওয়ার খবর দিয়ে শুরু করে শ্রোতারা সারাদিন বিভিন্ন তথ্য, স্বাস্থ্য সংবাদ ও বিনোদন পেয়ে থাকে বেতার থেকেই। বেতার সবচেয়ে প্রাচীন এবং জনপ্রিয় গণমাধ্যম হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বত্র। শ্রোতারা সত্য ও নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাচ্ছে বলে আস্থার মাধ্যম হয়েছে বেতার। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তাদের অধিকার পেতে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা ও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হতে শিখেছে বেতার থেকে। তাই বেতারের সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ২৪ জুলাই গণ-অভু্যত্থানকে বেতারের সব আয়োজন ও কার্যক্রমে সুন্দর করে সাজিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করলে সব শ্রোতা ও কলাকুশলী নতুন বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ, বিনোদন এবং তথ্য পাচ্ছি খুব সহজেই। কিন্তু এক সময় বেতার ছাড়া এগুলো কল্পনা করা যেত না। তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেতারও নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে আধুনিক রূপ ধারণ করেছে। এখন আর ব্যাটারি চালিত রেডিও সেট নিয়ে বেতারের বিভিন্ন তথ্য পেতে হয় না। বেতার এখন হাতের মুঠোয় এবং ভ্রাম্যমাণ হয়েছে। মোবাইলে আজ সহজেই বেতারের বিভিন্ন কেন্দ্রের সংবাদ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান শোনা যাচ্ছে। মোবাইল অ্যাপস এবং ফেসবুক লাইভে এখন বেতার নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছে। শ্রোতারা মোবাইলের সাহায্যে সহজেই বেতার থেকে যে কোনো তথ্য পাচ্ছেন। তাইতো এখন শ্রোতারা আয়োজন করে রাস্তার মোড়, চায়ের দোকান কিংবা বাড়ির উঠানে একসঙ্গে বেতার শ্রোতারা ভিড় জমায় না।
আমাদের দেশে বেতারের শ্রোতা কত এবং কতগুলো রেডিও আছে তা বলা কঠিন। তবে মোবাইল ব্যবহারকারী সবাই একজন বেতার শ্রোতা। কারণ খুব কম মোবাইল আছে যেখানে রেডিও শোনার ব্যবস্থা নেই। মোবাইলে সহজেই রেডিও শোনার ব্যবস্থা আছে বলে আলাদা করে সেট নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টেলিভিশন ব্যবহার কিংবা পত্রিকা পড়ার সুযোগ থাকে না বলে তারা আজ বেতারের ওপর নির্ভরশীল। বেতারের মাধ্যমে তারা সহজেই বিভিন্ন খবর ও প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে থাকে। আর এর জন্য তাদের আলাদাভাবে রেডিও সেট কিনতে হয় না। তারা সহজেই মোবাইলের মাধ্যমে রেডিও শুনে বলে ইচ্ছামতো তথ্য ও বিনোদন পেয়ে থাকে।
বেতার এখন শুধু প্রান্তিক ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নয় বরং ইট পাথরের ব্যস্ত নগরীতেও স্থান করে নিয়েছে। যানজট ও ব্যস্ত নগরীতে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বেতার। এফএম কিংবা অ্যাপসের মাধ্যমে ক্লান্তি নিবারণ করতে শ্রোতারা ফিরে আসছে বেতারের কাছে। যানজট পরিস্থিতি, দেশ বিদেশের হালচাল, আগাম আবহাওয়া বার্তা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিভিন্ন তথ্য সহজেই পাচ্ছে বেতার থেকে। স্যাটেলাইটের ভিড়ে বেতার হারিয়ে যাবে এমন ভাবনা আজ অবাস্তব। কৃষক তার জমিতে ভালো ফসল ফলাতে বেতারের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছে। নারীরা তাদের শরীরের যত্ন, গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিশুর যত্ন ইত্যাদি তথ্য নিতে বেতারে কান পাতছেন। আবার মাঠে কিংবা দোকানে সর্বত্র একটু অবসরে বিনোদনের খোরাক যোগাচ্ছে বেতারের বিভিন্ন গান ও অনুষ্ঠান। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য আসর, ঘরে বসে শিখি, আমার ঘরে আমার স্কুল ইত্যাদি অনুষ্ঠান শিশু, অভিভাব ও শিক্ষকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তাইতো বেতার আজ সবার জন্য সবখানে।
স্যাটেলাইটের যুগে বেতার এখনো তার অস্তিত্ব হারা হয়নি। আজও মানুষ ব্যস্ততার মাঝে কান পাতে বেতারে। এখন হয়তো আগের মতো রেডিও সেট তেমন নেই। কিন্তু মোবাইল সেটের মাধ্যমে ঠিকই বেতারে পছন্দের অনুষ্ঠান খুঁজে নিতে ভুল করে না। কারণ বেতারের মাধ্যমে খেলার মাঠের তাজা খবর, সংবাদ, ধর্মীয় আলোচনা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক স্পট, কৌতুক ইত্যাদি শোনা যায়। তাই মনের অজান্তেই গাড়ির ড্রাইভার, রিকশা চালক, মুদি দোকানদার, চা বিক্রেতা, অফিসের বড় কর্তা, গৃহিণী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তরুণ-বৃদ্ধ, ছেলেমেয়ে সবাই বেতারের শ্রোতা হয়েছেন। আকর্ষণীয় উপস্থাপনা ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেতার তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে বলে বেতারকে আর শ্রোতা খুঁজতে হয় না। বরং শ্রোতারাই মনের টানে বেতারকে খুঁজে বেড়ায়।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ বেতার। এর অধীনে বিভাগীয় শহরগুলোতে আলাদাভাবে বেতারের আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। এক ঝাঁক মেধাবী ও কর্মঠ জনবল নিয়ে এখান থেকে শুধু সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রচারই হয় না বরং শ্রোতাদের পছন্দের বিভিন্ন অনুষ্ঠানও সম্প্র্রচার করা হয়। সরকার দেশের মানুষের জন্য কতটুকু ভাবে এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার বিভিন্ন তথ্য পাওয়ার একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বাংলাদেশ বেতার। বিভিন্ন কুইজ আয়োজনের মাধ্যমে শ্রোতাদের জ্ঞান বাড়াতে বাংলাদেশ বেতারের বিকল্প নেই।
দেশে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে অনেক বেসরকারি কমিউনিটি রেডিও এফএম সম্প্রচারের মাধ্যমে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করছে। এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই ভাষার সঙ্গে হাসি তামাশায় যুক্ত। বাংলা-ইংলিশের মিশ্রণে এক অন্যরকম ভাষা ব্যবহারে তাদের অনেকেই অভ্যস্ত। তরুণদের অনেকেই এমন উপস্থাপনাকে আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করছে।
তবে গণমাধ্যমের ভিড়ে বেতার এখন টিকে থাকলেও অনুষ্ঠানের মান আরও উন্নত হওয়া দরকার। তথ্য মানুষকে শক্তিশালী ও সচেতন করে। যে কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে সঠিক তথ্য দরকার। অনেক সময় উপস্থাপকদের ভাষাগত ভুল ও তথ্যের গড়মিল থাকায় সাধারণ ও অল্প শিক্ষিত মানুষ সঠিকটা খুঁজতে পারে না। দেশের অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কমিউনিটি রেডিও চালু হয়েছে। তারা হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন গান, ভাষা, নাটক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে বা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা করা হয় না। ফলে, তাদের ভিত্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচাতে তাই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
শাহাদাত হোসেন : সদস্য, কেন্দ্রীয় বেতার শ্রোতা ক্লাব, বাংলাদেশ বেতার
যংধযধফধঃ৩০@ুধযড়ড়.পড়স