তীব্র গ্যাস সংকটে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আগে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা গেলেও বর্তমানে প্রায় রাজধানীজুড়েই দেখা দিয়েছে ভয়াবহ গ্যাস সংকট। অনেক আবাসিক এলাকায় সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক এলাকায় রাত ১২টার পর গ্যাস এসে চলে যায় ভোররাতেই। ফলে বাসাবাড়িতে রান্নাবান্নায় সমস্যা হচ্ছে প্রতিদিন। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে রান্নার আইটেম কমিয়ে দিতে হয়েছে। অনেককে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কখন গ্যাস আসে তার জন্য।
গ্যাসসংকটের উদ্বেগজনক প্রভাব পড়েছে শিল্পাঞ্চলে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানিমুখী শিল্পসহ নানা কলকারখানায় উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। বস্ত্র, সিরামিক, তৈরি পোশাক ইত্যাদি শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ার পস্ন্যান্টে গ্যাসের চাপ হ্রাস পেয়েছে, মাঝেমধ্যে একেবারেই থাকছে না। অথচ গত ৯ বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ৩৫০ শতাংশ। দেশে প্রায় দুই হাজার বস্ত্রকলের মধ্যে সাত শতাধিক স্পিনিং মিল। গ্যাসসংকটে এগুলোর অর্ধেকই বন্ধ হয়ে গেছে। সবগুলো চালু থাকলে কর্মসংস্থান হতো প্রায় এক লাখ মানুষের। এই সুযোগে প্রতিবেশী দেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে সুতা আমদানি হচ্ছে। অন্যদিকে, সিরামিকশিল্প পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর। গ্যাস এ খাতে কাঁচামাল হিসেবে বিবেচিত এবং এর আর কোনো বিকল্প জ্বালানিও নেই। তাদের উৎপাদন ৫০ শতাংশে নেমে গেছে। অর্ধশতাধিক সিরামিক কোম্পানি পুনর্বিনিয়োগ বন্ধ করেছে। বেশ কটি নতুন কারখানা উৎপাদনেই যেতে পারেনি। মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোকসানের শিকার এ শিল্প। একই সংকটে, বিশ্বব্যাপী চামড়াপণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হলেও তা আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে। গত মাসে শিল্পবাণিজ্যসংশ্লিষ্ট চারটি প্রধান সংগঠনের নেতারা যৌথভাবে বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টাকে চিঠি দেন। তাতে জ্বালানিসংকটে শিল্পকারখানার সমস্যা, উৎপাদনে অনিশ্চয়তা ও আর্থিক ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে সমাধান আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি উন্নতির পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
যেখানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে ৩৮০ কোটি ঘনফুট, সেখানে ২৫০ কোটি ঘনফুট দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। যদিও সফলতা নিয়ে সংশয় আছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মাতারবাড়ীর মহেশখালীতে একটি ভাসমান রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকায় এই সংকট বেড়েছে। এ কারণে ১ জানুয়ারি থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ১০০০ থেকে ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। আশার কথা, মহেশখালীর এফএসআরইউ রোববার রাত থেকে চালু হয়েছে। এর ফলে আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মানুষ এখন দ্বিমুখী সংকটে আছে। একদিকে গ্যাসের সরবরাহ কম, অন্যদিকে নতুন শিল্পকারখানায় দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে। এটি বৈষম্যমূলক প্রস্তাব। পুরোনো শিল্পের সঙ্গে নতুন শিল্প প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। এতে বিনিয়োগে উৎসাহ কমে যাবে। ইতিমধ্যে সরকার যে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়ে দিয়েছে, তা জনজীবনে প্রভাব ফেলবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া ছিল, ভ্যাট বাড়ানোর পর আরও অনেক পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে।
মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, কলাবাগান, উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ নেই। দিনে গ্যাস না থাকায় অনেক স্থানে রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও গ্যাসের চাপ কম। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয় শিল্পকারখানায়। এবার গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। গত রোববার গাজীপুরে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ কোটি ঘনফুট। নারায়ণগঞ্জেও চাহিদামতো গ্যাস পায়নি তিতাস। ফলে রপ্তানিশিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কারখানাগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। কোথাও কোথাও রেশনিং করে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই গ্যাস সংকট বেড়েছে। তারা গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চেয়ে বিদেশ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানির ওপর জোর দিয়েছিল। এর পেছনে কমিশন বাণিজ্যও ছিল। কিন্তু উত্তরণের পথ তো বের করতে হবে। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের সময় বাড়িয়ে উন্মুক্ত করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে সরকার দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ইতিবাচক হলেও সময়সাপেক্ষ।
সে ক্ষেত্রে সরকারকে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি তরল গ্যাস আমদানির পরিমাণও বাড়াতে হবে। চালু গ্যাসক্ষেত্র থেকে আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা যায় কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। ভোলার গ্যাস দেশের অন্যান্য স্থানে এলএনজির মাধ্যমে সরবরাহের কাজটিও জোরদার করা প্রয়োজন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জ্বালানি খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। বর্তমান সরকার লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে আমরা এ-ও আশা করি যে, গ্যাস খাতের দুর্নীতির ছিদ্রগুলো বন্ধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এখনো বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের অনেক অবৈধ সংযোগ আছে, যা থেকে রাষ্ট্র কোনো অর্থ না পেলেও ফায়দা নিয়ে যায় দুর্নীতিবাজরা।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, গ্যাস-বিদু্যতের সংকট জিইয়ে রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবে না। রেশনিং পদ্ধতিতে কারখানা চালু রাখতে হলে মালিকের ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি পড়বে। দেশবাসী অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে একটি বাস্তবমুখী নীতি-পরিকল্পনা এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন আশা করে।
পেট্রোবাংলা বলছে, পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করা হলে অথবা নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা'য়ের মতো, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে ব্যবসায়ীদের পুঁজি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাদেরই বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ফসল শিল্পকারখানা জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এগুলোতে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। কিন্তু নানা কারণে ব্যাংকগুলো এ সময় তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারছে না। সব মিলে শিল্পখাত কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কর্মসংস্থান, প্রত্যাশিত উন্নয়ন ও জাতীয় অর্থনীতির অভীষ্ট সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে এ খাতের সব সংকট দূর হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য কার্যকর বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হোক। বিলম্বে ক্ষতিবৃদ্ধি। তাই শুভস্য শীঘ্রম।
বেড়েছে গ্যাসের দামও। ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সংযোগের দাম বাড়ানোর ফলে এর চাপ গিয়ে পড়ছে দৈনন্দিন রান্নাবান্নায়। যে বা যারা বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন, তাদের প্রতি মাসে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সিস্টেম লস কমালে গ্যাস সরবরাহে সাশ্রয়ী হওয়া যেত কিছুটা হলেও।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা