একাকিত্ব এক সময় কেবল শারীরিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক সমাজে এটি একটি গভীর মানসিক সংকটে পরিণত হয়েছে- যা মানুষের চারপাশে অনেক লোক থাকলেও অনুভূত হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অগ্রগতি, নগরায়ণ, কর্মব্যস্ততা, পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন মানুষের একাকিত্বের অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মানুষ আজ ডিজিটাল মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত, কিন্তু মানসিকভাবে আগের চেয়ে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, মানসিক স্বাস্থ্য এমন একটি বিষয় যা অতীতে অনেকাংশে অবহেলিত ছিল। এক সময় মানসিক সমস্যাকে দুর্বলতা বা অযথা আবেগপ্রবণতা হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু বর্তমানে এটি একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, স্ট্রেসসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যার মূল কারণগুলোর মধ্যে একাকিত্ব অন্যতম। তাই একাকিত্ব ও মানসিক স্বাস্থ্য এখন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আগে মানুষ পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে বেশি আবদ্ধ ছিল। পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা ছিল জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার কর্মজীবন ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর গুরুত্ব কমে যাচ্ছে।
অনেক মানুষ কর্মব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারে না, আবার কেউ কেউ ব্যক্তি স্বাধীনতার অজুহাতে সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলে। বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে। কর্মজীবনের চাপে মানুষ ব্যক্তিগত সময় ও সম্পর্কের প্রতি কম মনোযোগ দেয়- যা দীর্ঘমেয়াদি একাকিত্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অনেক ক্ষেত্রে, মানুষ একাকিত্ব বোধ করলেও তা প্রকাশ করতে চায় না। কারণ, সমাজে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। ফলে, মানুষ তার সমস্যাগুলো নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে- যা পরবর্তী সময়ে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও আত্মবিশ্বাসের সংকট তৈরি করে।
প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আমাদের যোগাযোগের ধরন নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের একদিকে যেমন সংযুক্ত করেছে, তেমনি অন্যদিকে একাকিত্বকেও বাড়িয়ে তুলেছে।
আগে যেখানে মানুষ চিঠি লিখত, একে অপরের বাড়িতে যেত, সরাসরি কথা বলত, সেখানে এখন একটি মেসেজ বা ইমোজি পাঠিয়েই যোগাযোগের কাজ সেরে ফেলা হয়। এটি সম্পর্কের গভীরতা কমিয়ে দিয়েছে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গায় এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা হাজারো মানুষের সংস্পর্শে থাকলেও প্রকৃত অর্থে কতজনের সঙ্গে আমাদের মানসিকভাবে গভীর সম্পর্ক আছে? ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আমরা যত বেশি সংযুক্ত হচ্ছি, বাস্তব জীবনে তত বেশি দূরে সরে যাচ্ছি। সোশ্যাল মিডিয়া একদিকে যেমন মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সুবিধা বাড়িয়েছে, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ সাধারণত নিজের জীবনের সুখী মুহূর্তগুলো শেয়ার করে। কিন্তু যারা এই পোস্টগুলো দেখে, তারা নিজেদের জীবনকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশ হয়ে পড়ে। অন্যদের সফলতা দেখে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে হতে পারে- যা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আমাদের অনেক 'ফ্রেন্ড' বা 'ফলোয়ার' থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্ব অনেক সময়ই অনুপস্থিত। আমরা হয়তো সারাদিন স্ক্রলে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু মনের কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে পাই না। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক মন্তব্য, ট্রলিং বা সাইবার বুলিং মানুষের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিতে পারে। অনেকে এর কারণে হতাশায় ভোগে এবং সামাজিক যোগাযোগ কমিয়ে ফেলে। অনেক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, তারা বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও কাজকে অবহেলা করতে থাকে। এতে মানসিক চাপ ও একাকিত্ব আরও বেড়ে যায়। একাকিত্বের প্রভাব শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি একাকিত্ব মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলতে পারে- যা ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘদিন একাকিত্বে ভোগে, তাদের মধ্যে হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি থাকে। একাকিত্ব মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিশক্তি দুর্বল করে দেয়। ভার্চুয়াল সংযোগের বাইরে বাস্তব সম্পর্ক গড়ে তুলতে একাকিত্ব দূর করার জন্য ভার্চুয়াল যোগাযোগের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানো : পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করা, বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করা এবং একসঙ্গে আনন্দ করার মাধ্যমে একাকিত্ব দূর করা সম্ভব।
সৃজনশীল কাজে যুক্ত হওয়া : বইপড়া, ছবি আঁকা, সঙ্গীত চর্চা, খেলাধুলা বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা গেলে একাকিত্ব কমে।
সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ: স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা ক্লাবের সদস্য হওয়া নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে। প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা এবং বাস্তব জীবনে বেশি সময় দেওয়া উচিত।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি : মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা এবং প্রয়োজনে থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
একাকিত্ব এখন কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য সংকট। প্রযুক্তি আমাদের সংযুক্ত করেছে, কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে আমরা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সামাজিকতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সম্পর্কের গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের সঙ্গে মনের কথা ভাগ করা, আবেগ প্রকাশ করা এবং একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করা একাকিত্ব কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বাস্তব জীবনে আন্তরিক সম্পর্কই সামাজিক যোগাযোগের প্রকৃত সংজ্ঞা।
হালিমা আক্তার হানী : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ