পৃথিবী স্বার্থের কষাঘাতে বন্দি। আর সেই স্বার্থ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ক্ষমতার মসনদে বসেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর এক আকস্মিক সিদ্ধান্ত বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে, দিচ্ছে। ট্রাম্প যে জনসমর্থনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন এখন সে সমর্থনের ওপর অনেকখানি ভাটা পড়তে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পূর্বেই ট্রাম্পের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে শান্তি উদ্যোগ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইল ও গাজার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা বিশ্বমহলে কিছুটা শান্তির পূর্বাভাস এনে দিয়েছিল। কিন্তু তিন সপ্তাহের কিছুটা বেশি সময় আগে হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত হতবাক করছে।
বিগত বাইডেন প্রশাসনের আমলে দুনিয়াজুড়ে যে সংকট বা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল মনে হচ্ছে এখন সেই সংকটেরই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই ট্রাম্পের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আমেরিকা ফার্স্ট নীতি থেকে কিছু সরে আসার ইঙ্গিত বিশ্বমহলে বেশ বাহবা কুড়িয়েছিল। সবাই ভেবেছিল বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ সংঘর্ষ ও দখলদারিত্বের ইতি হবে এবার। বছর তিনেক পূর্বে জো বাইডেনের যুদ্ধবাজি মনোভাবের কারণেই শান্তিকামী বিশ্বে ২০২১ সালে ইসরাইল-ফিলিস্তিন ও ২০২২ সালে রাশিয়া- ইউক্রেন দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল। এই দুই যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিশ্বের গতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে নানাভাবে। আমরা দেখেছি, বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির অবস্থানে ধরে রাখতে যেভাবে তার সামরিক ও আধিপত্যবাদী কৌশল প্রয়োগ করেছেন, প্রথম দফার রাষ্ট্র পরিচালনায় ট্রাম্প সে বিবেচনায় ভিন্ন পথে হেঁটেছিল। পূর্ব দিগন্তে চীনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান ঠেকানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষমতাধর রাজনীতিকরা যেখানে অশনিসংকেত বলে মনে করেন, সেখানে অন্যান্য রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্টের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বরাবরই ভিন্ন। বিশ্বের তথ্যাভিজ্ঞমহলের মতে, ট্রাম্প একজন কট্টর পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী। তিনি রাজনীতি কিংবা কূটনীতির চেয়েও তার ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় তার এই রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছেন অনুরূপ ঘোষণা দিয়ে। তিনি মনে করেন, একটি শক্তিশালী অর্থনীতিই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি, উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে, যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা সংঘাত-সংঘর্ষ নয়। মুখে স্বীকার না করলেও প্রকৃত অর্থে ট্রাম্প শেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসী।
ট্রাম্প কখনো কোনো প্রথাগত রাজনীতি কিংবা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করেননি। কিন্তু কেন এত অল্পসময়েই ট্রাম্প সমালোচনার কবলে, কেন ট্রাম্পের মধ্যে উচ্চাভিলাষী দখলদারিত্বের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, কেন ট্রাম্প বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য তড়িঘড়ি করে প্রস্তুতি নিচ্ছে এসব প্রশ্নে উদ্বিগ্ন বিশ্বরাজনীতির গবেষকরা। চলতি বছরের ১ ফেব্রম্নয়ারি কানাডা, মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ এবং চিনের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক কর আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করে যে, কানাডা ও মেক্সিকো সীমান্তে অবৈধ অভিবাসন এবং চীনের মাদক চোরাচালান ঠেকাতে যথার্থ পদক্ষেপ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কট্টরপন্থি এই বাণিজ্য দ্বন্দ্বে হোয়াইট হাউসের অনড় অবস্থানে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দাভাব ও বেগবান প্রতিযোগী বিশ্ব কিছুটা স্থবির হতে শুরু করে। বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ আরোপের ফলে আসন্ন যে বিশ্বসংকট তার মুখে যেন পড়তে না হয় সেজন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউমের সঙ্গে কয়েক দফা ফোনালাপ এবং বন্ধুপ্রতীম আলোচনার মধ্যে দিয়ে ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর আরোপিত শুল্ক কর ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করে। তবে মেক্সিকো ও কানাডা সীমান্তে ট্রাম্প সেনারা পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোকে ছেড়ে কথা বললেও চিনের বিষয়ে কেমন সিদ্ধান্ত নেবে সে বিষয়টি ধোঁয়াশার মধ্যে ছিল। তবে এরই মধ্যে গত ৪ ফেব্রম্নয়ারি থেকে চিনের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর এই শুল্ক কর কার্যকর করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
এছাড়াও আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন নতুন ভূখন্ড যুক্ত করার কথা বলছেন। একই মুখে তিনি আবার বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা চিরস্থায়ী যুদ্ধে জড়াবেন না এমনটিও বলছেন। ট্রাম্পের এই দ্বিমুখী অস্পষ্ট কথা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। হঠাৎ করেই তিনি বলে বসলেন, তিনি চান যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিক এবং এর পুনর্গঠন করুক। আপাত তার এই বক্তব্য আকস্মিক মনে হলেও আসলে মোটেই তা নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হচ্ছে তার এই বক্তব্য। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার বিধ্বস্ত গাজাবাসীকে জোরপূর্বক গাজা থেকে সরিয়ে একটি ভালো, সুন্দর ও বিপদমুক্ত ভূমিতে পুর্নবাসনের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। ট্রাম্পের এই স্বেচ্ছাচারী পরিকল্পনা আদতে কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত না হলেও ইহুদি জায়োনবাদী নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এমন হঠকারিতাকে যুগান্তকারী বলে প্রশংসা করেন। বলা যায় ট্রাম্পের এই গাজা সম্প্রসারণ নীতির অন্তরালে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সূর্য চিরতরে স্তিমিত যাওয়ার ইঙ্গিত। এ কারণেই ফিলিস্তিনের রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এমন পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়- তবে তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান আগুনে ঘি ঢালার শামিল।
আমরা দেখেছি, গত ১৫ মাসের ব্যবধানেই দখলদার ইসরাইলি আগ্রাসনের মুখে গাজায় প্রাণ হারিয়েছে ৪৭ হাজার মানুষ, লাখ লাখ মানুষ অঙ্গহানি ও বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে। বলাবাহুল্য, গাজা উপত্যকার দক্ষিণ রাফার অবস্থা তো শোচনীয়। ট্রাম্প শপথ নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের 'অন্তহীন যুদ্ধের' বেড়াজাল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা যে ছিল সাজানো মিথ্যা নাটক তা আর বিশ্বমহলে বুঝতে বাকি নেই। এছাড়া চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক শুল্ক করের বোঝা ব্রিকস অধিভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত করলেও চীনের পাল্টা করারোপ বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বিশ্ববাজারে ঘাটতি সৃষ্টি করবে। এভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি আরও বেশি বিশৃঙ্খল হবে। ভুল সিদ্ধান্তের খেসারতে বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের নব্য উপনিবেশবাদী ডালপালা এবার কাটা পড়বে কিনা সেই দুশ্চিন্তার ভাঁজই এখন পশ্চিমাদের কপালে।
আসিফ আহমেদ : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়