বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ ইতিহাস, বাস্তবতা ও পরিপ্রেক্ষিত

বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ইতিহাস দীর্ঘ, বৈচিত্র্যময় এবং এটি প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হয়ে এসেছে। বিভিন্ন জাতি ও দেশ তাদের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রয়োজন মেটাতে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করেছে।

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

লে. কর্নেল সোফিয়া জেরিন তামান্না রহমান
বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি দেশের বিশেষ সামরিক প্রক্রিয়া, যেখানে নির্দিষ্ট বয়সসীমার নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্দিষ্ট বয়সসীমার এই নাগরিকদের প্রয়োজন সাপেক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কেননা, তারা অস্ত্রের বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান, সামরিক রণকৌশল, যুদ্ধ উপযোগী শারীরিকভাবে ফিটনেস এবং যুদ্ধকালীন যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দক্ষ হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ লাভ করে। এটি তাদের মধ্যে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্বদানের বিষয়সমূহ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ করে তোলে। বিশ্বের অনেক দেশেই এই প্রশিক্ষণ বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় একটি বাধ্যবাধকতা হিসেবে পরিচালিত হয়। বিশ্বের দেশে দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতেও অনেক সময় প্রচলন করা হয়েছে, বিশেষ করে যুদ্ধ পরিস্থিতি বা সার্বভৌমত্ব বিষয়ক হুমকি মোকাবিলায় এটি প্রচলনের অনেক নজির রয়েছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারি নীতিমালা, প্রশিক্ষণ অবকাঠামো সুবিধা, অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। এটি মূলত জাতীয় প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা, নাগরিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করা এবং জরুরি পরিস্থিতিতে প্রস্তুত থাকা বা মোকাবিলা করার লক্ষ্য নিয়ে প্রচলন করা হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের প্রচলনের ইতিহাস : বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ইতিহাস দীর্ঘ, বৈচিত্র্যময় এবং এটি প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হয়ে এসেছে। বিভিন্ন জাতি ও দেশ তাদের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রয়োজন মেটাতে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করেছে। প্রাচীন গ্রীসের 'স্পার্টা' বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বিখ্যাত ছিল। স্পার্টান ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য থাকত- যা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলত। এই প্রশিক্ষণে শারীরিক সক্ষমতা, অস্ত্র পরিচালনা, দলগত কাজ এবং যুদ্ধ কৌশল শেখানো হতো। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মানসিক শক্তি গড়ে তোলাই এর মূল লক্ষ্য ছিল। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর, প্রতিটি স্পার্টান পুরুষ সৈনিক হিসেবে সমাজে কাজ করত এবং রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করত। 'স্পার্টা'র এই ব্যবস্থা তাদের সামরিক শক্তি এবং শৃঙ্খলাবোধের জন্য বিখ্যাত করেছিল। মধ্যযুগে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতো। এ সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাথমিকভাবে রাজ্য বা সামন্ত প্রভুদের দ্বারা সংগঠিত হতো- যার লক্ষ্য থাকতো শাসকদের ক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা- যা বিভিন্ন সময়ে সামরিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইউরোপে ফিউডাল ব্যবস্থার অধীনে জমির মালিকরা নিজেদের সামরিক শক্তি বজায় রাখতে প্রজাদের থেকে সৈনিক সংগ্রহ করত। প্রজাদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হতো এবং যুদ্ধের সময় প্রভুদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হতো। ইংল্যান্ডে ১২৮৫ সালে 'ঝঃধঃঁঃব ড়ভ ডরহপযবংঃবৎ' আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমস্ত যোগ্য পুরুষকে অস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষিত হওয়া এবং সামরিক সেবা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। একইভাবে, জাপানে সামুরাই ব্যবস্থার অধীনে কৃষকদের মাঝে সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হতো। আধুনিক যুগে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ইতিহাস মূলত ফরাসি বিপস্নবের সময় (১৭৮৯-১৭৯৯) থেকে শুরু হয় যেখানে বিপস্নবী সরকার প্রথমবারের মতো বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার ধারণা প্রবর্তন করে। ফ্রান্সে ১৭৯৩ সালে 'খবাবব বহ গধংংব' নীতির আওতায় সমস্ত যোগ্য পুরুষকে সামরিক সেবায় যোগ দিতে বাধ্য করা হয়- যা একটি শক্তিশালী জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনে সহায়ক হয়েছিল। এটি আধুনিক বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের একটি মাইলফলক। ১৯শ' শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু হয়। এই ধারাবাহিকতায় জার্মানি বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যকর করে তাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে- যা ১৮৭০-৭১ সালের ফরাসি-জার্মানি যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০শ' শতাব্দীতে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ প্রায় সব দেশেই প্রচলিত হয়। এটি জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠে। বর্তমানে রাশিয়া, ইসরাইল, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ড ছাড়াও অনেক দেশ বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। এসব দেশে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুরুষ এবং কখনো নারীদেরও নির্দিষ্ট সময় সামরিক সেবায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব :সামরিক প্রশিক্ষণ শুধু সামরিক দক্ষতাই নয়, বরং নৈতিক শিক্ষা, শারীরিক সক্ষমতা এবং দলগত কাজের মানসিকতা গড়ে তোলে। এটি ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র- তিন ক্ষেত্রেই নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে : ১। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ তরুণদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে। সময়নিষ্ঠা, আদেশ মান্য করা এবং দায়িত্ব পালন করার মানসিকতায় তারা যে কোনো দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়। একক ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং দলগত কাজের দক্ষতা এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা গড়ে তোলার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত কার্যকর। ২। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ যুবসমাজকে শারীরিক ও মানসিকভাবে যোগ্য করে তোলে। নিয়মিত অনুশীলন এবং কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং চাপ মোকাবিলা করার দক্ষতা অর্জন করে। ৩। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। জরুরি পরিস্থিতিতে যেমন যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত নাগরিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৪। সামরিক প্রশিক্ষণ ব্যক্তি জীবনে শৃঙ্খলা, সময়নিষ্ঠা ও আদেশ মেনে চলার মানসিকতা তৈরি করে। এটি সমাজে সুশৃঙ্খল এবং দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি করতে সাহায্য করে। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এই সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের আত্মনির্ভরশীল ও সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। ৫। সামরিক প্রশিক্ষণ ব্যক্তির মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে এবং জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী করে। এটি জাতি, ধর্ম বা সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে। ৬। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি দেশের যুবসমাজকে সুশৃঙ্খল, দায়িত্বশীল এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকে পরিণত করতে পারে- যা জাতীয় উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় অমূল্য অবদান রাখে। ৭। যে কোনো দেশের সামরিক বাহিনীর নির্দিষ্ট সদস্য সংখ্যা থাকে, কিন্তু সংকটকালে অতিরিক্ত বাহিনীর প্রয়োজন হয়ে থাকে। বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ফলে দেশ একটি দক্ষ রিজার্ভ বাহিনী তৈরি করতে পারে। ৮। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিকরা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ও কর্মঠ যুবসমাজ হিসেবে কর্মক্ষেত্রে উচ্চ দক্ষতা প্রদর্শন করে- যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতাসমূহ:বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ বিভিন্ন দেশে উপকার বয়ে আনে- তবে, এর ফলে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে : ১। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য সরকারের বড় বাজেট প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো, সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষকদের জন্য অর্থ বরাদ্দ একটি দেশের বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ২। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ ব্যক্তির স্বাধীন পেশা বা শিক্ষা নির্বাচন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। বিশেষ করে, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে যুবসমাজের অনেকেই প্রশিক্ষণের সময় ব্যক্তিগত ও পেশাগত লক্ষ্য থেকে বিচু্যত হন। ৩। সামরিক প্রশিক্ষণের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ অনেক অংশগ্রহণকারীর জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে। ৪। প্রশিক্ষণের সময় তরুণরা চাকরি বা ব্যবসা থেকে দূরে থাকে- যা দেশের উৎপাদনশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ তরুণদের কর্মজীবনে প্রবেশে বিলম্ব ঘটায়। ৫। সব নাগরিক একই সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে সক্ষম নাও হতে পারে। স্বাস্থ্যগত বা আর্থিক অবস্থার কারণে অনেকের জন্য এটি অযৌক্তিক হতে পারে। কিছু দেশে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য- যা বৈষম্যের জন্ম দেয়। নারীদের অন্তর্ভুক্তি না করা বা কিছু পেশার লোকদের অব্যাহতি দেওয়ার ফলে সামাজিক অসন্তোষ দেখা দেয়। ৬। বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই প্রশিক্ষণ পরবর্তী সামরিক পরিসেবায় আগ্রহী থাকে না বরঞ্চ শুধু বাধ্যবাধ্যকতার কারণে সামরিক পরিসেবায় শ্রম দিয়ে থাকে। ফলে, তারা পেশাদার সেনাবাহিনীর তুলনায় কম দক্ষ হয়। ৭। বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ সমাজের সামরিকীকরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে- যা অগণতান্ত্রিক চিন্তাধারা এবং সামাজিক অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে সামরিক প্রশিক্ষণ সামাজিক জীবনে অতিরিক্ত সামরিক প্রভাব ফেলেছে। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের পরিচালনা পদ্ধতি: বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা ও কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হয়। পুরো প্রক্রিয়া দক্ষ তদারকির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এটি জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নাগরিকদের সামরিক দক্ষতা উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনার ধাপগুলো নিম্নোক্তভাবে বিন্যস্ত করা যেতে পারে- ১। আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ: সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য আইন পাস করে, যাতে পরিষ্কারভাবে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য এবং কাঠামো বিবৃত থাকে। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বয়সসীমার (সাধারণত ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়) নাগরিকদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক নির্ধারণ করা হয়। ২। নিবন্ধন ও বাছাই প্রক্রিয়া: নির্ধারিত বয়সের নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণে যোগদানের জন্য সরকার আহ্বান জানায়। আবেদনকারীদের নাম, ঠিকানা, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় যোগ্য প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়। ৩। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ: প্রশিক্ষণকালীন সময়ে মৌলিক সামরিক জ্ঞান, সামরিক ইতিহাস, সামরিক নীতি ও নৈতিকতা, আইন সম্পর্কে শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও আদেশ মানার অভ্যাস তৈরি, শারীরিক ফিটনেস বৃদ্ধি, ভারী সরঞ্জাম বহন, কৌশলগত গতিশীলতা শেখানো, রাইফেল বা ক্ষুদ্রাস্ত্র এবং অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহারের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ৪। বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ: প্রশিক্ষণকালীন সময়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ হিসেবে যুদ্ধ কৌশল, গেরিলা যুদ্ধ, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা কৌশল, যোগাযোগ প্রযুক্তি, গোপন সিগন্যালিং, ড্রোন পরিচালনা, যানবাহন চালনা, জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকে। ৫। রিজার্ভ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি: প্রশিক্ষণের শেষে দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণার্থীদের গ্রেড ও সনদ প্রদান করা হয়। সফল অংশগ্রহণকারীদের সামরিক বাহিনীর রিজার্ভ ইউনিটে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং নির্ধারিত সময় পরপর তাদের পুনরায় প্রশিক্ষণের জন্য ডাকা হয়। দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের সক্রিয় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। ৭। সামাজিক পুনর্বাসন: বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে কিছু দেশে প্রশিক্ষণার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে দেশকে সামরিক পরিসেবা দেয়ার বিধান রয়েছে। এ ব্যতীত সব প্রশিক্ষণার্থীদের পুনরায় বেসামরিক জীবনে ফিরিয়ে নেয়া হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের সময় অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমান বিশ্বের কয়েকটি বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনাকারী দেশসমূহের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত- রাশিয়া : তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৮ সালে রেড আর্মি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাশিয়ায় বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের সময় বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ সামগ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে অনেক দেশ আত্মপ্রকাশ করলেও, রাশিয়ায় বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা অব্যাহত থাকে, যা ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সি পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য ছিল এবং বর্তমানেও এটি কার্যকর আছে, সময়ের পরিক্রমায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ কৌশলের প্রশিক্ষণের মানোন্নত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি রাশিয়ার বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের গুরুত্বকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া : দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া বিগত ৭২ বছর ধরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আভিযানিক/স্নায়ু/প্রযুক্তিনির্ভর ছায়া যুদ্ধ করছে। রাজনৈতিক বৈরিতার ফলে উভয় দেশ তাদের সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করেছে। দুই কোরিয়াতেই বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ইতিহাস কোরিয়ান যুদ্ধ (১৯৫০-১৯৫৩) পরবর্তী সময়ে শুরু হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় এটি ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সি পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক- যার মেয়াদ সাধারণত ১৮-২৪ মাস। পুরুষদের হয় সেনাবাহিনীতে (২১ মাস), নৌবাহিনীতে (২৩ মাস) বা বিমানবাহিনীতে (২৪ মাস) অন্তর্ভুক্ত থাকে। সশস্ত্র বাহিনী ছাড়াও পুলিশ বাহিনী, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিসও এই বাধ্যতামূলক সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত। সফল ক্রীড়াবিদ, যেমন যারা অলিম্পিক বা এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছেন, তারা বাধ্যতামূলক পরিষেবা থেকে ছাড় পেয়ে থাকেন। উত্তর কোরিয়া একটি সামরিক-প্রথম নীতি অনুসরণ করে যা 'সোঙ্গুন' নামে পরিচিত, যার অধীনে সমস্ত কিছুতেই সামরিক বাহিনীর জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। উত্তর কোরিয়ায় স্কুল গ্র্যাজুয়েটদের ১৭-১৮ বছর বয়সের জন্য নির্বাচন করা হয়। বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ/সামরিক চাকরির পরিষেবা পুরুষদের জন্য ১০ বছর এবং মহিলাদের জন্য সাত বছর করা বাধ্যতামূলক। সামরিক পরিষেবা আগে মহিলাদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী ছিল কিন্তু ২০১৫ সালে এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইসরাইল:ইসরাবইলে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের সূচনা দেশটির প্রতিষ্ঠা (১৯৪৮) লগ্ন থেকেই চালু করা হয়েছে, সেই সময় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংঘাতের কারণে প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার প্রয়োজন ছিল।'ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স' (ওউঋ)-এর অধীনে ১৮ বছর বয়সি নারী ও পুরুষ উভয়ের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণ/সামরিক চাকরি পুরুষদের জন্য ৩০ মাস এবং নারীদের জন্য ২৪ মাস বাধ্যতামূলক। ইসরাইলি সমাজে এটি শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম এবং ঐক্য গঠনের একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে দেখা হয়। ইসরাইলি আরব, ধর্মীয় মহিলা, বিবাহিত ব্যক্তি এবং যারা চিকিৎসা বা মানসিকভাবে অযোগ্য বলে বিবেচিত তাদের বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের শেষের দিকে ইসরাইল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষায় পাওয়া গেছে যে, প্রায় অর্ধেক (৪৭ শতাংশ) ইহুদি ইসরাইলি বাধ্যতামূলক চাকরির অবসান চান। ব্রাজিল :ব্রাজিলের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রতিটি পুরুষ ব্রাজিলিয়ান নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের বিধান রয়েছে। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ/সামরিক চাকরি সর্বনিম্ন ১২ মাস এবং সর্বোচ্চ ৮ বছর পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে তালিকাভুক্ত সদস্য হিসেবে চাকরি করতে পারে। একটি নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর অধীনে ১৮ বছর বয়সি নারী ও পুরুষ উভয়ের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণ কেউ প্রত্যাখ্যানের করলে তার ভোট দেওয়ার অধিকার বা নির্বাচনী ম্যান্ডেটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ রাজনৈতিক অধিকার স্থগিত করা হয়। সরকারি যে কোনো চাকরির আবেদন করার সময়ও এই প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করার সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। এই ক্ষেত্রে নারীদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ থাকলেও বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ইরান :ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, ১৮ বছরের বেশি বয়সি সমস্ত পুরুষদের (স্বাস্থ্যগত কারণ ব্যতীত) ১৮ থেকে ২৪ মাসের জন্য সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ/চাকরি বাধ্যতামূলক। তবে ইরানে নারীদের জন্য সামরিক চাকরি বাধ্যতামূলক নয়। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ ব্যতীত অব্যাহতি চাওয়া বা কোনো কারণে এই প্রশিক্ষণ না করলে যে কোনো সরকারি চাকরির জন্য অযোগ্য এবং দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞাসহ বেশিরভাগ নাগরিক অধিকার হারাতে হয়। তুরস্ক :তুরস্কে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের দৈর্ঘ্য ছয় মাস। তুরস্কে বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা ২০ থেকে ৪১ বছর বয়সি সমস্ত পুরুষ নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য। যারা উচ্চশিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাদের পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিষেবা বিলম্বিত করার সুযোগ দেয়া হয়। বিদেশে বসবাসরত তুর্কি নাগরিকদের একটি নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। উপসংহার :বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নাগরিকদের শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম এবং নেতৃত্ব গুণ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি যুবসমাজকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুসংগঠিত হতে সাহায্য করে এবং জাতীয় চেতনা জাগ্রত করে। যদিও অনেক দেশ এই ব্যবস্থাকে ঐতিহাসিক কারণ বা পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে পরিহার করেছে, কিছু দেশে এটি এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ আরও আধুনিক হচ্ছে- যা ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর। তবে, বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। একটি সুশৃঙ্খল ও সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি জাতিকে আরও সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করতে পারে। লে. কর্নেল সোফিয়া জেরিন তামান্না রহমান : পিএসসি, সিগন্যালস্‌