বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়েছে। লক্ষ্য করছি, কিশোর-কিশোরী এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও আত্মহত্যা বা আত্মহননের মাধ্যমে তাদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট আত্মহত্যা সম্পর্কে বলেছেন, আত্মহত্যা জীবনের সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়। আত্মহত্যা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। এ অসুস্থতায় ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করে। জাপানসহ উন্নত দেশে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ২০০০ সালে জাপানে আত্মহনন করেছিল প্রায় ৩৩ হাজার লোক। বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়েছে। বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি যুবক-যুবতীরা বেশি আত্মহত্যা করে থাকেন। মূলত হতাশ, বিষণ্নতা এবং প্রেমের ব্যর্থতার কারণে নিজের সুন্দর জীবনকে আত্মহননের মাধ্যমে শেষ করে দেয়।
মনোবিজ্ঞানীদের মত হলো, আত্মহননের প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে চিরকাল ছিল। এটা নতুন কোনো কথা নয়। ফুলের মতো ছোট ছোট কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে নানা কারণে। সংসারে অশান্তির সহ্য করতে না পেরে আর বেঁচে থাকতে চায়নি। এমনকি লেখাপড়ায় ব্যর্থতার কারণেও আত্মহননের পরিমাণ আগে ছিল অনেক। এখন ইন্টারনেট, ফেসবুক, মোবাইল ইত্যাদির যুগে আত্মহত্যা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এমনকি অনেকে ফেসবুক অন করে আত্মহত্যা করছে। এটা প্রতিরোধ করা জরুরি। একজনেরটা দেখে আরেকজন শেখে।
আত্মহত্যা ভয়ানক ব্যাধি। কেননা, জীবন সম্পর্কে সমস্ত আগ্রহ নিঃশেষে মুছে যেতে দেওয়া যায় না। বিবিএস সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশের হিসাব মোতাবেক বছরে গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে বা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। যারা আত্মহত্যা করে তারা নিজেদের অন্যের ওপর বোঝা মনে করে। জীবনের প্রতি হতাশা বিতৃষ্ণা, অতিরিক্ত রাগ, ক্ষোভ, মানসিক চাপ, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক, প্রেমের ব্যর্থতা, পরকীয়া, রাত জাগার বদঅভ্যাস, মাদকাসক্তি, ধর্ষিতারা সাধারণত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকে। আত্মহত্যার মূল কারণসমূহ হচ্ছে : পরীক্ষায় ফেল করা, পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, ভাইবোন বা প্রেমিক-প্রেমিকার ওপর অভিমান করা, প্রেমঘটিত বিষয়, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি ও মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, মানসিক সমস্যা, বিয়ে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, মোটর সাইকেল কিনে না দেওয়া, নেশাগ্রস্ত, বিষণ্নতা, আর্থিক সমস্যা, যৌতুক বা স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন ইত্যাদির মধ্যে অন্যতম।
আত্মাহত্যার প্রতিকার : বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সাইকোথেরাপি, ইতিবাচক মনোভাব, সহানুভূতি, বন্ধুত্বের ইতিকে প্রসারিত করা, কথা বলার ও আবেগ ভাগাভাগি করার পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য। রুখতে হবে ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যা। জীবনটা অনেক বড় এবং অনেক কিছু করার এবং জানার আছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বাইরেও একটা জগৎ আছে। কথা বলতে হবে এবং সবার সঙ্গে মিশতে হবে। পছন্দের কাজ করতে হবে এবং এর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। নিজেকে বলতে হবে আমি ভালো থাকব। পছন্দের মানুষের সঙ্গে বেশি করে মিশতে হবে। যোগাযোগ রাখতে হবে সবার সঙ্গে। পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে। সাফল্য ব্যর্থতা, ভালো-মন্দ থাকা এগুলো জীবনের অঙ্গ। সময়ের ওপর ধৈর্য রাখতে হবে। আজ না হয় কাল সাফল্য আসবেই। মনের কথাগুলো খুলে বলতে হবে। বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মনের সমস্যার কথাগুলো শেয়ার করা খুবই দরকার। একান্তে না পারলে প্রয়োজনে মনোবিদদের শরণাপন্ন হওয়া কোনো দোষের নয়। আমি ভালো থাকতে চাই। আমার ভালো থাকা কেউ আটকাতে পারবে না। এই কথাটি মন্ত্রের মতো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কাউন্সেলিং চিকিৎসা খুব জরুরি। কেউ কাউন্সেলারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তাকে ভুল বুঝা ঠিক হবে না। আমি তো মানসিক রোগী নই... কেন যাব মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে...- এ ধরনের প্রশ্ন ভাবনায় আনা ঠিক না।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তি, পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ব্যাপক সচেতনার প্রয়োজন রয়েছে। কারো মধ্যে আত্মহত্যার লক্ষণ বা কারণ দেখা দিলে তাকে কখনো উপহাস, ঠাট্টা করা ঠিক নয় বরং ওই ব্যক্তির মনের কথা সহমর্মিতা দিয়ে শুনতে হবে। পরিবারের কারোর মধ্যে এমন আচরণ দেখা দিলে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। মানসিক কষ্ট লাঘবের জন্য এ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অতি গুরুত্বপূর্ণ।
মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী : গণমাধ্যম কর্মী ও কলাম লেখক