মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

কৃষি জমি রক্ষায় দেশ এগিয়ে যাবে

দেশের অনেকাঞ্চলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, দুই ফসলের জায়গায় এক ফসল হচ্ছে- এ অবস্থায় বিদ্যমান কৃষিজমির যত্ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি অনাবাদি জমিকে চাষযোগ্য করে তোলা জরুরি। অপরিকল্পিতভাবে কৃষিজমিতে ঘরবাড়ি, স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নগরায়ণের বিষয়টি অস্বীকার করা না গেলেও তা পরিকল্পিতভাবে করা প্রয়োজন।
ড. ফোরকান আলী
  ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কৃষি জমি রক্ষায় দেশ এগিয়ে যাবে
কৃষি জমি রক্ষায় দেশ এগিয়ে যাবে

আবাদি জমি মানেই ফসলের উৎস। ফসল মানেই মানবের খাদ্য। জীবন ধারণের জন্য মানুষকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। আর সেই খাদ্য মানুষকেই উৎপাদন করতে হয়। উৎপাদিত ফসল বা শস্য থেকেই জোগান দিতে হয় খাদ্যের। কিন্তু সেই জমিই যদি হয়ে যায় উজাড়, তবে চাষাবাদের ক্ষেত্রও হতে থাকে সঙ্কুচিত। লোপাট হয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি। জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণ যদি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, তবে খাদ্যশস্য উৎপাদনও কমে আসে। চাহিদানুযায়ী খাদ্যে জোগান হয়ে পড়ে দুষ্কর।

জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির পরিমাণ যাচ্ছে কমে। আবাদি জমি পরিণত হচ্ছে ক্রমশ আবাসিক ভূমিতে। কলকারখানাসহ নানাবিধ স্থাপনায় ঢেকে গেছে কৃষি জমি। সবচেয়ে ক্ষতিকর যে কাজটি হচ্ছে, তা হচ্ছে আবাদি জমির ওপর আইন লঙ্ঘন করে অবাধে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ইটভাটা। কৃষি জমিগুলো ধ্বংস করে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ এবং স্থানীয় কৃষকরা। কৃষি জমির উপরের অংশের মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। ইটভাটার ক্ষতিকর ধোঁয়ায় আশপাশের কৃষি জমিগুলোর ফলন যাচ্ছে কমে। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষকরা ক্রমশ সরে যাচ্ছে কৃষি খাত থেকে। ফলে বর্গচাষি দরিদ্র কৃষক হয়ে যাচ্ছে স্বল্প মজুরির শ্রমিক। বদলে যাচ্ছে তার জীবনজীবিকার পেশা। এমনকি আবাসিক এলাকার মাঝখানেও একের পর এক গড়ে উঠছে অবৈধ ইটভাটা। এসব ভাটাতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে পরিবেশের নিকটতম বন্ধু বৃক্ষ। অবাধে নিধন হওয়া বৃক্ষগুলো এ খাতে ঠাঁই পাচ্ছে। ভাটা থেকে নির্গত ছাই ও ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান। এ ছাই ও ধোঁয়া মূলত কার্বন মনো-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের উৎস। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, আবার ইট প্রস্তত্মুত খাত দেশের গ্রিন হাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস হওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের খাদ্যচক্র।

পরিবেশ অধিদপ্তরই বলছে, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ ভাগ। এভাবে পরিবেশ দূষণের ফলে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। মূলত কৃষিজমির উপরের উর্বর অংশ কেটে ইট তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে সরকার গত ২০১৫ সাল থেকে পোড়া ইটের বিকল্প পণ্যের ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে। চিমনিতে পোড়ানো ইটের বদলে বস্নক ইট বানাতে সরকারি-বেসরকারি কারখানার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ২০১৫ সালে সরকারি সব নির্মাণকাজে (সড়ক ছাড়া) শতভাগ বস্নক ইট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে পরিপত্র জারি করা হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু অগ্রগতি সামান্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে মাত্র ১৫১টি বস্নক ইটের কারখানা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হয়েছে ৮৮টি কারখানা। এসব কারখানা দেশের ইটের চাহিদার ৫ শতাংশও মেটাতে পারছে না। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে ড্রামচিমনির ভাটাসহ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় নয় হাজার সাত শ'টি। যার প্রায় পঞ্চাশ ভাগই অবৈধ। এসব ভাটাতে আধুনিক প্রযুক্তির পরিবর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ড্রামচিমনির ও ১২০ ফুট উচ্চতায় স্থায়ী চিমনির ভাটাতে পোড়ানো হচ্ছে ইট। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩তে বলা আছে- আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, সদর, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য বাগান বা জলাভূমি, কৃষিজমি ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া আইন লঙ্ঘন করে নিষিদ্ধ এলাকায় অবৈধ ইটভাটা প্রস্তত্মত করলে পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে।

কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যপট ভিন্ন, আইন রয়েছে কেতাবেই সীমাবদ্ধ। কোনো অনুমতি ছাড়াই দেশজুড়ে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। কেন হয়েছে, বা হচ্ছে! কারণ, আধুনিক নগরায়ণের কথা এলে, ইটের কথা আগে আসে। সুউচ্চ ভবন, দালান-কোঠা, রাস্তা-ঘাট নির্মাণে ইটের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। এই অপরিহার্যতাকে পুঁজি করে ইট উৎপাদনে যেমন একের পর এক ইটভাটা গড়ে উঠছে, তেমনি এসব ইটভাটা কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই যত্রতত্র স্থাপন করা হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ ইটভাটাই গড়ে উঠছে কৃষিজমিতে এবং লোকালয়ের আশপাশে। এতে কৃষিজমি কমে যাওয়া থেকে শুরু করে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। রাজধানীর আশপাশের অঞ্চলে তো বটেই সারদেশেই কৃষি জমিতে আইনের তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে জালের মতো ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই কৃষিজমিতে ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এতে ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রামেই নয়, আমরা যদি ঢাকাসহ চারপাশের এলাকাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তবে দেখা যাবে, অসংখ্য ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করে চলেছে। এর কোনো প্রতিকার নেই। ইট প্রস্তত্মত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী, কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া, আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক থেকে অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষিজমি ও অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপনের ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম্য বন্ধে আইনটি করা হলেও এর প্রয়োগ যেমন হচ্ছে না, তেমনি ভাঁটা স্থাপনকারীরাও তা মানছে না। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট এলাকার ফসল উৎপাদন ও পরিবেশের ওপর পড়ছে। আইন অমান্য করে যেখানে সেখানে ইটভাটা স্থাপনের লাগাম যদি টেনে ধরা না যায়, তবে কৃষি ও পরিবেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা অননুমেয় নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। নদীভাঙন এবং বসতবাড়ি, রাস্তা-ঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণ মূলত এর জন্য দায়ী। খাদ্য সংকট মোকাবিলা এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে যেখানে কৃষিজমি সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই, সেখানে যথেচ্ছভাবে কৃষিজমি কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অনেকাঞ্চলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, দুই ফসলের জায়গায় এক ফসল হচ্ছে- এ অবস্থায় বিদ্যমান কৃষিজমির যত্ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি অনাবাদি জমিকে চাষযোগ্য করে তোলা জরুরি। অপরিকল্পিতভাবে কৃষিজমিতে ঘরবাড়ি, স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নগরায়ণের বিষয়টি অস্বীকার করা না গেলেও তা পরিকল্পিতভাবে করা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, যে যেভাবে পারছে সেভাবেই নগরায়ণ করে চলেছে। এই নগরায়ণে ইটের জোগান দিতে গিয়ে আইনের তোয়াক্কা না করে কৃষিজমিসহ লোকালয়ের আশপাশে ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। রাজধানী থেকে বের হওয়ার পথে সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, বুড়িগঙ্গার তীরসহ আশপাশের এলাকায় দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে অসংখ্য ইটভাটা। ইটভাটা থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত ধোঁয়া আশপাশের এলাকার পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। নগরায়ণের ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প নেই বললেই চলে। তার অর্থ এই হতে পারে না, কৃষিজমি ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে ইট উৎপাদন করতে হবে। এর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

একদিকে ইটভাটা ও স্থাপন করতে হবে, অন্যদিকে তা যাতে কৃষিজমি ও পরিবেশের ক্ষতি না করে, সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের দেশে ইট তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হয়। বিপুলসংখ্যক এই কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েও দেখা গেছে আশপাশের বন উজার হয়ে যাচ্ছে। আবার ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড, মনোঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত উপকরণ থাকায় চারপাশের পরিবেশ ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এলাকায় বসবাসকারি মানুষজনও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইটভাটার এসব ক্ষতিকর দিক বছরের পর বছর ধরে চলছে। সংশ্লিষ্টদের কাছে আমরা পরিবেশবান্ধব আধুনিক ইটভাটার আশা করতেই পারি। ইটভাটা অনুমোদন দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সরজমিনে পরিদর্শন করে অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কৃষিজমি বাঁচাতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। ইটভাটায় কাঠের ব্যবহারের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। উন্নত বিশ্বে কাঠের পরিবর্তে বৈদু্যতিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ রক্ষার্থে এ পদ্ধতি আমাদের দেশেও অবলম্বন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার। ইটভাটার ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে কেউ ভাবছে না। জনগণ চায়, এসবের নিয়ন্ত্রণ। এরপরও জনস্বাস্থ্য রক্ষায়ও বিষয়টি গুরুত্ব পাবে- এমন নিশ্চয়তা চায় দেশবাসী।

ড. ফোরকান আলী : গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে