বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিপস্নবের অন্যতম প্রধান পস্ন্যাটফর্ম টিকটক। ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে বিনোদন, শিক্ষা, বিজ্ঞাপন ও তথ্য আদান-প্রদান- সবই সম্ভব এই মাধ্যমে। তবে একইসঙ্গে এটি তরুণদের মধ্যে নানা নেতিবাচক প্রভাবও ফেলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও ডিজিটাল সচেতনতার অভাব রয়েছে, সেখানে টিকটকের নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তরুণদের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ থাকলেও, টিকটক এখন নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তার আশায় বিপজ্জনক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে, যা তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে।
টিকটকের মূল আকর্ষণ এর সংক্ষিপ্ত ও সহজলভ্য ভিডিও কনটেন্ট। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন ব্যবহারকারী বিনোদিত হতে পারেন, যা তরুণদের মধ্যে দ্রম্নত আসক্তি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ১৫-২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে টিকটকের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। টিকটক বিশেষভাবে তরুণদের মনোযোগ কমিয়ে দিচ্ছে, তাদের ধৈর্যশক্তি কমিয়ে আনছে এবং পড়াশোনা ও বাস্তব জীবনের দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। টিকটক ব্যবহারের ফলে তরুণদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছে। একবার টিকটক চালু করলে সময় কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অথচ তারা বুঝতেও পারে না। ফলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় খারাপ ফল করছে এবং পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে। টিকটক পস্ন্যাটফর্মে ভাইরাল হওয়ার জন্য অনেক তরুণ-তরুণী অশ্লীল ও অনৈতিক কনটেন্ট তৈরি করছে। ফলোয়ার ও লাইক পাওয়ার লোভে অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা বিসর্জন দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের কনটেন্ট সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। টিকটককে কেন্দ্র করে অনেক তরুণ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে টিকটক গ্যাং কালচার বেড়ে চলেছে, যেখানে তরুণরা সংঘবদ্ধভাবে অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো, মারামারি, এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটেছে। সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণত মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি করে। বিশেষ করে যখন কেউ অন্যদের তুলনায় কম লাইক বা ফলোয়ার পায়, তখন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। টিকটকের কারণে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। টিকটকের মাধ্যমে অনেক ব্যবহারকারী নিজের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করে, যা সাইবার অপরাধীদের জন্য সহজলভ্য হয়ে যায়। অনেক প্রতারক এই পস্ন্যাটফর্মের মাধ্যমে তরুণদের ফাঁদে ফেলে বস্ন্যাকমেইলিংসহ বিভিন্ন অনলাইন অপরাধ ঘটাচ্ছে।
টিকটকের নেতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। অনেক তরুণ এই পস্ন্যাটফর্ম ব্যবহার করে সৃজনশীল কনটেন্ট তৈরি করছে, যা তাদের ক্যারিয়ারে সাহায্য করছে। অনেক তরুণ তাদের শিল্প, সংগীত, নাচ, অভিনয় ও অন্যান্য প্রতিভা টিকটকের মাধ্যমে প্রকাশ করছে, যা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অনেক শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও গবেষক টিকটক ব্যবহার করে শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি করছেন, যা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণে সহায়তা করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা তাদের পণ্য ও সেবা প্রচারের জন্য টিকটককে ব্যবহার করছে। এটি বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
টিকটকের কুফল থেকে তরুণদের বাঁচাতে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাবা-মাকে সন্তানের ডিজিটাল জীবন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং তাদের অনলাইন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে ডিজিটাল লিটারেসি বিষয়ক পাঠ্যক্রম চালু করা যেতে পারে। সরকারকে কঠোরভাবে টিকটকের অনৈতিক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণদের মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা রাখতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে টিকটকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে। তবে তরুণদের মধ্যে এটি যেভাবে বিপথগামীতা সৃষ্টি করছে, তা রোধ করতে সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে টিকটক হতে পারে শিক্ষার মাধ্যম ও ক্যারিয়ার গঠনের হাতিয়ার। কিন্তু ভুল পথে গেলে এটি তরুণদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে। অতএব, সময় এসেছে অভিভাবক, শিক্ষক, সরকার ও সমাজের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার, যাতে তরুণরা টিকটকের কুফল থেকে বাঁচতে পারে এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিখতে পারে। শুধুমাত্র সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলেই টিকটক তরুণদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, অন্যথায় অভিশাপ স্বরূপ।
জাফরিন সুলতানা : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়