অপরিকল্পিত নগরায়ণ কৃষি খাতের জন্য হুমকি

বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো কৃষিজমি। এটিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে দেশের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই পরিবেশগত ভারসাম্য, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিজমি সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

মো. মিথিলা খাতুন
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। আমাদের জাতীয় আয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি বড় অংশ কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে কৃষিজমির পরিমাণ ভয়াবহ হারে কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে উর্বর মাটির জন্য বিখ্যাত- যা ফসল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এমন সময় খুব দূরে নয়, যখন অর্থ থাকলেও ধান চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাবে না। এক সময় বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিস্তীর্ণ মাঠ দিগন্তজোড়া সবুজের শোভা বৃদ্ধি করত। কিন্তু নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে এখন এমন দৃশ্য বিরল হয়ে গেছে। নদীভাঙন ও বন্যাও কৃষিজমি হ্রাসের অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণ অঞ্চলে অসংখ্য কলকারখানা ও ইটভাটা গড়ে উঠেছে, যা শুধু কৃষিজমি দখলই করেনি বরং পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি করছে। একইভাবে, মাছ চাষের জন্য পুকুর খননও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে, ক্রমাগত আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। জমির ক্ষয়ের পাশাপাশি বায়ু, পানি ও মাটির দূষণও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। আবাদযোগ্য জমি কমে যাওয়ার ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, ফলে বহু মানুষ জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। এতে নগরাঞ্চলে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে এবং নগর পরিবেশও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক জনসংখ্যা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০-৩০ লাখ মানুষ বাড়ছে। কিন্তু এই বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানো ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। ফলে, দেশকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ৬৯,০০০ একর কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানায়, বাংলাদেশ ১০.৫ মিলিয়ন টন খাদ্য আমদানি করেছে- যা ২০২২ সালে ১১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে খাদ্য উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফারাককে নির্দেশ করে।এই সমস্যা সমাধানে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আবাদযোগ্য জমি ব্যবহার করে সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ না করে অনাবাদি ও উঁচু জমি ব্যবহার করা উচিত। কৃষিজমির মাটি ইট তৈরির কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং বিকল্প হিসেবে সিমেন্ট বস্নক ব্যবহারের প্রচলন বাড়াতে হবে। নদীভাঙন প্রতিরোধে উন্নত প্রযুক্তি, যেমন টেক্সটাইল ব্যারিয়ার, কৃত্রিম বাঁধ ও ড্রেসিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। কৃষিজমি সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পুকুর খনন, অপরিকল্পিত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং উর্বর জমির অপব্যবহার বন্ধ করা জরুরি। বড় নদীগুলোর চরে কৃষিকাজ সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো কৃষিজমি। এটিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে দেশের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই পরিবেশগত ভারসাম্য, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিজমি সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মো. মিথিলা খাতুন : শিক্ষার্থী, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া