মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

খাদ্য সুরক্ষা এবং নিরাপদ খাদ্য কত দূরে?

কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও দিন দিন আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বাজার, দোকান, সুপারশপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। মাছেও ফরমালিন, দুধেও ফরমালিন। ফলফলাদিতে দেওয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভেজালের বেপরোয়া দাপটের মধ্যে আসল পণ্য খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর।
আবু আফজাল সালেহ
  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
খাদ্য সুরক্ষা এবং নিরাপদ খাদ্য কত দূরে?
খাদ্য সুরক্ষা এবং নিরাপদ খাদ্য কত দূরে?

খাদ্য মানুষের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী আমরা খাদ্যঘাটতি পুরণের কথা বলেছি। কয়েকবছর পরে সুষমখাদ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি এসেছে। বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলছি। নিরাপদখাদ্য ও খাদ্যসুরক্ষা এখন আলোচিত একটি বিষয়। নিরাপদ খাদ্য সুষমখাদ্য- যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নয়, উপকারী। নিরাপদ খাদ্য বলতে স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্যকে বোঝায়। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও জীবাণুমুক্ত খাদ্যকে নিরাপদ খাদ্য বলে। বৈজ্ঞানিকভাবে খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন, প্রস্তুত ও পরিবেশন করাকে নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা বলে।

বাঙালির কিছু চরিত্রগত খারাপ দিকগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কোনো কিছু সামনে রেখে কাজ করা এবং নিজের স্বার্থ বা মুনাফা (আর্থিক বা বৈষয়িক উভয়) লক্ষ্য স্থাপন করে এগিয়ে যাওয়া। আর সংকাটপন্ন অবস্থা বা উপলক্ষকে সামনে রেখে মুনাফা অর্জনের জন্য সারা বছর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এ-দিকটি মানবতাবিরোধী এবং নিষ্ঠুরও বটে। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল এমনকি শিশুখাদ্যেও ভেজাল করতে পিছপা হচ্ছি না! এবং সেটার পরিসর আরো মারাত্মক ও অনৈতিকতার জাল অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। রোগীর চরম অবস্থায় আমরা ব্যবসা খোঁজার চেষ্টা করি। রিকশাচালকরা পর্যন্ত দালালিতে জড়িত। অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুনাশক ওষুধেও সমানহারে ভেজাল। নিম্নমানের ওষুধে উন্নত মানের ওষুধের দাম নির্ধারণ করছি! বর্তমানে ফসল উৎপাদন ও বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার করে থাকি। এসব রাসায়নিক দ্রব্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক হুমকি। বিভিন্ন রাসায়নিক ছাড়াও খাদ্যতে বিভিন্ন প্রকারের জীবাণু ও অণুজীব থাকে। এগুলো মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে এবং রোগপ্রতিরোধক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ফুড পয়জনিং-সহ ফুড-ইনফেকশন সমস্যার সম্মুখীন হয়। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৪২০,০০০ মানুষ অসুস্থতার কারণে মারা যায়। এছাড়া দূষিত খাবারের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মৃতু্য হচ্ছে ৪ লাখ ২০ হাজার জনের। ভারত-বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রতি বছর দূষিত খাবার খেয়ে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ মারা যায়। আর অসুস্থ হয় ১৫ কোটি মানুষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি ১০ শিশুর তিনজনই ডায়রিয়ায় ভোগে। রোগটি এ অঞ্চলের শিশুমৃতু্যর জন্য দায়ী সবচেয়ে ভয়াবহ রোগগুলোর একটি। কম বয়সি শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও প্রবীণরা খাবারে দূষণের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। টাইফয়েড জ্বর এবং হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বে যত মানুষের মৃতু্য হয়, তার অর্ধেকের বেশি ঘটনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। বিভিন্ন সমীক্ষায় ভেজালের ভয়াবহতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে তৈরি হচ্ছে টোস্ট বিস্কুট, বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয় কলা, আনারস। রুটি, বিস্কুট, সেমাই তৈরি করা হচ্ছে বিষাক্ত উপকরণ দিয়ে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে। ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে মাছ-সবজিতে, মবিল দিয়ে ভাজা হচ্ছে চানাচুর, হাইড্রোজ মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে মুড়ি ও জিলাপি। এছাড়া ক্ষতিকর রং দেওয়া ডাল, ডালডা ও অপরিশোধিত পামঅয়েল মিশ্রিত সয়াবিন তেল, ভেজাল দেওয়া সরিষার তেল, রং ও ভেজালমিশ্রিত ঘি, পামঅয়েল মিশ্রিত কনডেন্সড মিল্ক, ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার, মরা মুরগির মাংশও অবাধে বিক্রি হয়। ভেজালের এসব উপকরণসহ অভিযানে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর পরও ভেজালের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। টেক্সটাইল রং মেশানো হচ্ছে বেকারি পণ্য, জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে।

ওয়াটার লুর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নেপলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি রাখা হয়। কথিতআছে যে, প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে আর্সেনিক মিশিয়ে নেপলিয়নকে খেতে দেওয়া হতো। এভাবে সেস্না-পয়জনিংয়ের মাধ্যমে ফরাসি সেনাপতি নেপলিয়নকে হত্যা করে তাদের চিরশত্রম্ন ব্রিটিশরা। কিন্তু আজ আমরা নিজেরা নিজেদের সেস্না-পয়জনিং করে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। অনেক সময় দূষিত খাবার মানবদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যা মানুষের মৃতু্যর কারণও হতে পারে। প্রতিটি ধর্মে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া বা অনিরাপদ করা গর্হিত কাজ। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশ পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্রের দাম কমায় বা সহনীয় পর্যায়ে রাখে। আর আমাদের দেশে হয় ঠিক উল্টা। রোজা ও দু-ঈদের আগে খাদ্যে ভেজাল বেশি হয়। অথচ অনেক দেশে উৎসবে ছাড় দেওয়া হয়। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এ মাসকে সামনে রেখে সারা বছর ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য পরিকল্পনা আঁটে।

নিরাপদখাদ্য নিশ্চিত ও তা সুরক্ষার জন্য সরকার বিভিন্নসময়ে আইন কিংবা বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছে। পিউর ফুড অর্ডিন্যান্স-১৯৫৯ রহিত করে ১ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৫ নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। খাদ্য সুরক্ষা এ-আইনকে বাসস্তবায়ন করার জন্য 'বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ' প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ঋড়ড়ফ ঝধভবঃু (ঋড়ড়ফ ঈড়হঃৎড়ষ গধঃবৎরধষং) জবমঁষধঃরড়হ, ২০২৪, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) বিধিমালা-২০২৪, ঋড়ড়ফ ঝধভবঃু (অফাবৎঃরংবসবহঃ ধহফ ঈষধরসং) জবমঁষধঃরড়হং্ত২০২৪, ঋড়ড়ফ ঝধভবঃু (জবংরফঁবং ড়ভ ঠবঃবৎরহধৎু ধহফ ঋরংযবৎু উঁৎম) জবমঁষধঃরড়হং্ত২০২৪, ঋড়ড়ফ ঝধভবঃু (উবঃবৎসরহধঃরড়হ ্‌ ঈড়হঃৎড়ষ ড়ভ গরপৎড়নরড়ষড়মরপধষ ঈড়হঃধসরহধহঃং) জবমঁষধঃরড়হ্ত২০২৩, নিরাপদ খাদ্য (রাসায়নিক দূষক, টক্সিন ও ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ) প্রবিধানমালা-২০১৭ ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সরকার নিরাপদ খাদ্য সুরক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ভেজাল ও দূষণমুক্ত খাদ্য সুরক্ষা করতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ খাদ্য ভেজাল ও জরিমানা নিয়ে অনেক কিছুই পরিষ্কার করা হয়েছে। উলেস্নখযোগ্য দুটি ধারা হচ্ছে : (১) 'কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা উহার উপাদান বা বস্তু (যেমন- ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট), কীটনাশক বা বালাইনাশক (যেমন- ডিডিটি, পিসিবি তৈল, ইত্যাদি), খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি, আকর্ষণ সৃষ্টি করুক বা না করুক বা অন্য কোনো বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্ত করিতে পারিবেন না অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।'- (ধারা-২৩) এবং (২) 'কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণে কোনো ভেজাল দ্রব্য মিশ্রিত করিবার উদ্দেশ্যে, শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত তৈল, বর্জ্য বা কোনো ভেজালকারী দ্রব্য তাহার খাদ্য স্থাপনায় রাখিতে বা রাখিবার অনুমতি প্রদান করিতে পারিবেন না।'-(ধারা-২৮)। তারপরেও খাদ্য ভেজাল কমছে কই?

কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও দিন দিন আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বাজার, দোকান, সুপারশপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। মাছেও ফরমালিন, দুধেও ফরমালিন। ফলফলাদিতে দেওয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভেজালের বেপরোয়া দাপটের মধ্যে আসল পণ্য খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর। শুধু আইন করে খাদ্য সুরক্ষা করা কঠিন হবে। সরকারি-বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে এগিয়ে আসলেই এ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে আপোসহীন মনোভাব থাকতে হবে। খাদ্য সুরক্ষা করার জন্য দরকার মানুষের বিবেক জাগ্রত করা। সচেতনতা ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষ করলেই কেবল খাদ্য ভেজালের মতো মারাত্বক হুমকির মতো জঘন্যতম কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মতো ধর্মীয় নেতাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।

আবু আফজাল সালেহ : কবি ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে