কিশোর গ্যাং বর্তমান সময়ে এক আতঙ্কিত নাম। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বেশিরভাগ সদস্যের বয়স হলো ১৮ থেকে ২০ বছর। সমাজের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা আমাদের মধ্যকার সৌহার্দ্য, সম্প্র্রীতি, ঐক্য, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রধান উপাদানগুলোকে ক্রমেই গ্রাস করছে। সমাজব্যবস্থা গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। কার্যত সমাজের অচলায়তন ও অধঃপতনের ক্রমধারা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। যদি আমরা এখনই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, বলাই বাহুল্য, এর খেসারত অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে।
উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং পত্রপত্রিকায় নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে কিশোর গ্যাং। যে শিরোনামে শঙ্কিত অভিভাবক, শঙ্কিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। বুক ধড়ফড় করা এ ধরনের শিরোনামে না জানি কার কপাল পুড়লো, কার আদরের সন্তানটা নিজের অগোচরে এই কিশোর গ্যাং এর সদস্য হচ্ছে। সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ, দমন করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাদের কর্মকান্ডে। সাধারণত ১৮ বছরের নিচে ছেলেমেয়েরা কিশোর হিসেবে বিবেচিত। তাই এই বয়সের ছেলেমেয়েরা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে তাদের কোনো শাস্তি দেওয়া যায় না। বড়জোর সংশোধনাগারে পাঠানো যায়। দেশে ২০১২ সাল থেকে কিশোর গ্যাং নামক সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃৃত হলেও বর্তমানে এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। যে বয়সে কিশোরদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে। কিশোর বয়স হচ্ছে স্বপ্ন পূরণের বয়স, স্বপ্ন দেখার বয়স। একটা ফুল যখন ফুটতে শুরু করে তখন যদি আঘাত করা হয়, তাহলে ফুলটা অকালে ঝরে যায়। কিশোররা আমাদের আগামীর কর্ণধার তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা আমাদের দায়িত্ব।
দেশজুড়ে বেড়ে চলা কিশোর অপরাধের প্রবণতা এখন সমাজের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে কিশোর-তরুণদের গ্যাং কালচার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদন বলছে, কিশোর-তরুণদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং এর ফলে, সমাজের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আমাদের সামাজিক কাঠামো এবং নৈতিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর-তরুণদের মধ্যে গ্যাং গঠনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তারা পাড়া-মহলস্নায় বাহিনী গঠন করছে। এ গ্যাংগুলো প্রাথমিকভাবে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য তৈরি হলেও বর্তমানে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, মাদক কারবার এবং এমনকি ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িত হচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক মহলের ইন্ধনেই এ গ্যাং কালচারের বিস্তার ঘটছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর। বর্তমানে দেশে প্রায় আড়াই শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় এবং এর সদস্যসংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। এ গ্যাং সদস্যদের মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান যেমন রয়েছে, তেমনি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানও রয়েছে।
কিশোর অপরাধ সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, মিরপুরের মতো এলাকাগুলো গ্যাং কালচারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে তারা ভয় পান। গ্যাং সদস্যদের মহড়ার সময় বাসাবাড়ির জানালা ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। আদালতে 'কিশোর অপরাধী' হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় তাদের রিমান্ডে নেওয়া সম্ভব হয় না। অপরাধীদের অনেকেই দ্রম্নত জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা যথেষ্ট নয়। কিশোর অপরাধ নির্মূলে অভিভাবক, শিক্ষক এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত কিশোরদের সংশোধনের জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শাস্তির পরিবর্তে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের অপরাধ থেকে দূরে রাখা যেতে পারে। কিশোর অপরাধের এ উত্থানের পেছনে প্রযুক্তির অপব্যবহারকেও দায়ী করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও অপরাধমূলক কনটেন্ট দেখে প্রভাবিত হচ্ছে কিশোররা। পাশাপাশি, অবাধে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তাদের সঠিক ও ভুলের সীমারেখা ভুলিয়ে দিচ্ছে। কিশোর অপরাধ দমনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। সমাজের প্রত্যেক স্তরে কিশোর-তরুণদের সচেতন করা এবং তাদের গঠনমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত করা অপরাধপ্রবণতা কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।
সরকারের উচিত, কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে একটি স্থায়ী এবং কার্যকর নীতি প্রণয়ন করা। স্থানীয় পর্যায়ে যুব ক্লাব ও ক্রীড়া সংগঠনের কার্যক্রম বাড়িয়ে তরুণদের সুস্থ বিনোদনের সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। স্কুল ও কলেজে নৈতিক শিক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধমূলক কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে তাদের সন্তানের গতিবিধি নিয়ে। কিশোর অপরাধের উত্থান প্রতিরোধ করা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নয়, এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক দায়িত্ব। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগে কিশোরদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলেই সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যাবে। এখনই সময় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার। সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেলে তা দ্রম্নত কিশোরদের অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ঘরে স্বামী-স্ত্রী নিত্য ঝগড়া কলহ আর বিয়েবিচ্ছেদ এবং অভিভাবকদের অসচেতনার কারণে সন্তান বেপরোয়া হয়ে বিপথে চলে যায়। অর্থাভাব যেমন একটি কিশোরকে অপরাধ জগতের দিকে ধাবিত করে, তেমনি অর্থের প্রাচুর্য ও কখনো অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেবন করছে দামি সিগারেট, ভয়াবহ মাদক।
সমাজ চিন্তকরা মোটা দাগে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই কিশোর গ্যাং নামক সামাজিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে গণ্য করছেন। এক সময় পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। অন্যায় করতে দেখলে পাড়ার বড়রাও ছোটদের শাসন করতে পারত। এখন সেই ঐতিহ্য আর নেই। ভেঙে পড়েছে সামাজিক মূল্যবোধ। একটি সমাজের জন্য সামাজিক মূল্যবোধ এবং সহনশীলতা খুবই জরুরি। সহনশীলতার ওপর নির্ভর করে সমাজের স্থিতিশীলতা। সহনশীল মনোভাব মানুষকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে। তাই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই অপসংস্কৃতি এবং অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে। তবেই সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। দেশ ও জাতি ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে নিস্তার পাবে।
কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পাড়ায় বা মহলস্নায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়াসহ কিশোর অপরাধ রোধে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
ওসমান গণি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট