মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মান কোথায়?

শিক্ষক আর মা-বাবার সম্মান যখন একটা জাতিকে চোখে আঙুুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় তখন সে জাতির আত্মিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায়। স্মার্ট শিক্ষার জন্য যে স্মার্ট শিক্ষক প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি করতে হবে এ দেশের প্রতিটি মানুষকে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মান কোথায়?
প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মান কোথায়?

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে গার্মেন্টস শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করে কোনোমতে বেঁচে থাকার জন্য। তাদের বেতন কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। ঠিক তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষকের বেতন ১৭,৫৩০ / টাকা। যুগের সঙ্গে হিসাব করলে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়েনি বরং কমেছে। যেটা বেড়ে বেড়ে শতগুণ হয়েছে সেটা হলো- অসম্মান, অপমান। আমাদের প্রয়োজন মেধাবী, নৈতিক, সৃজনশীল, উন্নত জীবনমানের স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষক। আমলা দিয়ে প্রশাসন চলে, শিক্ষা নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত পাঠ্যপুস্তক, অধিক প্রশিক্ষণ সবই বৃথা যদি প্রকৃত শিক্ষকের কাছে শিক্ষাটা বুঝিয়ে না দেয়া যায়।

ভবিষ্যতের স্মার্ট জাতি গঠনের জন্য স্মার্ট শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু স্মার্ট শিক্ষক ছাড়া স্মার্ট শিক্ষা কী করে আশা করব? শিক্ষার প্রথম স্তর বা ভিত্তি প্রস্তর প্রাথমিক শিক্ষা। এই স্তরে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি থেকে বর্তমানে স্নাতক/ স্নাতকোত্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী মেধাবীরা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। এই মেধাবী শিক্ষকদের বেতন একজন ঝাড়ুদারের সমতুল্য। দেশ নানাভাবে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি ঘটেছে নানা পেশার। অথচ প্রাথমিকের শিক্ষকদের জীবনে কোনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। শিক্ষকদের ললাট লিখন একই রয়ে গেছে গত অর্ধশত বছর যাবত। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স মাস্টার্স। তার বেতনের চিত্রটা নিম্নরূপ : গ্রেড : ১৩তম বেতন স্কেল : ১১০০০/-২৬৫৯০/ বেসিক সেলারি : ১১০০০/ বাড়িভাড়া : ৪৯৫০/ চিকিৎসা ভাতা : ১৫০০/ টিফিন ভাতা : ২০০/ ইত্যাদিসহ নীটপ্রাপ্য : ১৭৫৩০/

একজন শিক্ষক এই বেতনে কেন তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করবেন?

সম্প্রতি ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের পদোন্নতি দিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। একজন এইচএসসি পাস ১৬ তম গ্রেডের কর্মচারী রাতারাতি দশম গ্রেডে উন্নিত হয়ে শিক্ষকদের স্যার হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এই অপমান কেন শিক্ষকদের হজম করতে হবে? অর্থনৈতিক অসম্মান ছাড়াও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে নৈতিক অসম্মানের মুখোমুখি শিক্ষকরা। সুতরাং, আত্মসম্মানবোধের কারণেই আজ শিক্ষকদের দাঁড়াতে হচ্ছে রাজপথে।

গুরু দ্রোণাচার্য তার অপমানের প্রতিশোধের জন্য তৈরি করেছিলেন অর্জুনকে। তার শিষ্য গুরুর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এ দেশের শিক্ষকরা শুধুই কি দুর্যোধন সৃষ্টি করেছেন? শিক্ষকদের ভাগ্য বদলের জন্য এ পর্যন্ত কোনো শিষ্য এগিয়ে আসেনি গুরুদক্ষিণা নিয়ে। কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যরা যখন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তায় পদোন্নতি পাচ্ছেন তখন শিক্ষকদের জন্য আজন্ম থেকে যাচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর অসম্মান। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর অসম্মান থেকে মুক্তির জন্য, শিক্ষকরা যখন রাজপথে দাঁড়ায় তখন শুনতে হয়, এই বেতনে না পোষালে অন্য পেশা খুঁজে নিতে!

সারাটা জীবন কষ্ট করে, জীবনের ২০ /২২বছর শেষ করে লেখাপড়া শিখে ১৭,৫৩০/ টাকা বেতনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর অসম্মানের জীবন কেন বহন করে শিক্ষকরা তা কি একবার ভেবেছেন? ক্ষমতার আসনে বসে এটা উপলব্ধির ক্ষমতা আপনার নেই। আসলে শিক্ষকতা সেই পেশা যেখানে একবার ঢুকলে মায়াজালে আটকে যায়। হাজারো অসম্মান, অপমান, আর্থিক দীনতা উপেক্ষা করে শুধু শিশুদের ভালোবাসায় আটকে যায় সে। এ এমনি এক মায়ার বাঁধন যা অন্য পেশার মানুষ বুঝবে না।

ঝাঁড়ুদারের সমতুল্য বেতন, সারা জীবন একই পদে থেকে পদোন্নতিবিহীন অবসরে যাওয়া, শাসক শ্রেণির স্বপ্নের বাস্তবায়নে নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তাদের সুরে সুর মিলানো। সামাজিক নানা অবজ্ঞার, অপমানের বোঝা বহন করা। সবটাই নীরবে সয়ে যায় শিক্ষক। শিক্ষার উন্নয়নে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় শিক্ষা পদ্ধতি, কারিকুলাম কিন্তু শিক্ষকের জীবনমানের উন্নয়ন থেকে যায় ব্রিটিশ আমলের পাদটীকা গল্পের পন্ডিত মশাইয়ের মতোই। হাজার কোটি, শত কোটির দুর্নীতিবাজরা হালাল রুজির উপদেশ দিয়ে যায়, শিক্ষকতা মহান পেশা এই গান শুনিয়ে যায়।

একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার জন্য কম পক্ষে ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। অথচ নন-ক্যাডার থেকে অভিজ্ঞতাবিহীন অল্প বয়সিদের প্রধান শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে। মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকতায় অনভিজ্ঞদের প্রধান শিক্ষক করা একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যেমন ক্ষতি তেমন ২০/২৫ বছর যাবত সহকারী শিক্ষক পদে যে সব অভিজ্ঞ শিক্ষকরা আছেন এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাদের জন্য অপমানের, অসম্মানের। শিক্ষক আর মা-বাবার সম্মান যখন একটা জাতিকে চোখে আঙুুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় তখন সে জাতির আত্মিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায়। স্মার্ট শিক্ষার জন্য যে স্মার্ট শিক্ষক প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি করতে হবে এ দেশের প্রতিটি মানুষকে।

শিক্ষকদের এবার লড়াই আত্মসম্মানের। অন্য পেশায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দাতা কি জানেন, শিক্ষকদের কাছে শিশুরা একতাল কাদা মাটির মতো। শিক্ষক শিল্পী হয়ে এই কাদা মাটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পীর স্বপ্ন, আবেগ, ভালো লাগা অনুভব করার সামর্থ স্বার্থপরদের থাকে না। শিক্ষক সমাজ বদলে দিতে পারেন না। তিনি সৃষ্টি করেন সমাজ বদলে দেওয়ার মানুষ। মানুষ তৈরির জন্যই এ দেশকে আগে শিক্ষক সৃষ্টিতে মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষকের উন্নত জীবনমান আর প্রথম শ্রেণির নাগরিক সম্মান অধিকার।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে