ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় মেয়াদে দেশটির ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। পূর্বঘোষণা অনুসারে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই বেশ কিছু চমক দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই শতাধিক নির্বাহী আদেশের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এটা ব্যতিক্রম মনে হলেও এটাই ট্রাম্প স্টাইল। এখানেই সম্ভবত ট্রাম্পের নিজস্বতা।
যেসব সিদ্ধান্ত ট্রাম্প নিচ্ছেন সেসব বিশ্বকে ভোগাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রকে কতটুকু কর্তৃত্ববাদী করে তুলবে সেটা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে কিছু সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা একলা চল নীতিতে অগ্রসর হতে চাইছে। এতে বিশ্ব পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে পারে। এসবের মধ্যে অভিবাসী নিয়ে উদ্বেগ, পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসাসহ বহু সিদ্ধান্ত চিন্তিত করলেও অবাক করেনি। একটি বিশাল বিজয়ের পর একটি নতুন যুক্তরাষ্ট্র গড়তে তিনি বদ্ধপরিকর। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যেকার যুদ্ধ আপাতত যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনা চলছে। কোন মন্ত্রে তিনি এটা করবেন, তা এখনো অধরা। ইতিমধ্যেই বাণিজ্যযুদ্ধের সুর বাজছে। একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর করা। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও একই অবস্থার তৈরি হয়েছিল। বাইডেন আসার পর আবার যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যায়। আগে থেকেই এই ধারণা ছিল। এবার সেটা কার্যকর হয়েছে। এর ফলে কী ঘটতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই বাকি বিশ্বকে এগিয়ে যেতে হবে একটি কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে। অথচ কার্বন নিঃসরণের দায় যুক্তরাষ্ট্রেরও অনেকখানি রয়েছে। সেই দায় উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অস্বীকার করা মানে হলো পরিবেশকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া। আপাতত যুক্তরাষ্ট্র সেটাই করতে যাচ্ছে। এখানে একলা হেঁটে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু লাভবান হবে সেটা দেখার বিষয়। ট্রাম্পের এই নির্বাহী আদেশে সইয়ের মাধ্যমে গত এক দশকের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী দেশটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।
এরপর আসা যাক, শুল্ক আরোপের কথায়। শুল্ক আরোপের কথা আগেই ছিল। তবে সেটা কতটা, সেটা নিয়ে দ্বিধা ছিল। এবার বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গেলো, ১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে চীনে তৈরি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কথা বিবেচনা করছেন তিনি। পাশাপাশি শুল্ক আরোপের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাম। কানাডার ওপর শুল্ক আরোপেরও কথা রয়েছে। বিপরীতে কানাডাও শুল্ক আরোপের কথা বলেছে। অর্থাৎ এরই মধ্যে বাণিজ্য অবস্থা কিছুটা তেঁতে উঠেছে। যেখানে অর্থনীতিকে একটু শীতল করার কথা সেখানে বৈশ্বিক অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়তে পারে। কয়েক দেশের মধ্যে শুল্ক আরোপের এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে অনেক দেশই তার ফল ভোগ করতে পারে। কারণ এটি এক ধরনের যুদ্ধই; তবে এখানে অস্ত্র হলো শুল্ক আরোপ করা। এই বাণিজ্যযুদ্ধ প্রকট হয়ে ওঠে বা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে। ওই সময় চীনের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্যযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল। তারপর নির্বাচনে পরাজিত হলে বাণিজ্যযুদ্ধ কমে যায়। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ফের ট্রাম্প। দক্ষিণ এশিয়ায় যেমন চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রভাব রয়েছে। চীনা পণ্যের আজ ব্যাপক পরিচিতি। বাণিজ্যযুদ্ধ প্রাণঘাতি না হলেও দুঃশ্চিন্তার তো বটেই। অবশ্য ট্রাম্পের ভাষায়, এটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনার কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনার কৌশল এটা হলে বিশেষত ইউরোপের ওপরও শুল্ক আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপরেও প্রভাব পড়তে পারে, যা নেতিবাচক হতে পারে। মিত্রদের অখুশী করে যুক্তরাষ্ট্রের একলা চলো দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং রাশিয়া ও চীনের সম্প্রতি আরও ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে পারে।
ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরে যেসব নির্বাহী আদেশে সই করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি। আরেকটি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইনসংক্রান্ত। এগুলো সই করার পরে ট্রাম্প বলেন, এসব বিষয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিসরে অভিবাসী বিতাড়ন কর্মসূচি চালু করার আশ্বাস দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে তিনি জন্মসূত্রে দেশটির নাগরিকত্ব পাবেন। দেড়শ' বছরের পুরনো এই সাংবিধানিক অধিকারকে 'হাস্যকর' বলেছিলেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি নতুন করে রাজনৈতিক ও আইনি জটিলতা বাড়াবে বলে মনে করছেন সমালোচকেরা। সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটো নিয়েও ট্রাম্পের নিজস্ব মত রয়েছে। ন্যাটোর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ট্রাম্পের মনঃপূত নয়। তিনি ইউরোপীয় সদস্যদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়েছেন। যদিও তিনি ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের কথা স্পষ্ট করেননি। তবে তিনি ইউরোপে মার্কিন সেনার সংখ্যা কমিয়ে ন্যাটোকে দুর্বল করে দিতে পারেন। এটা এমন একটা সময় যখন রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে এবং এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্র ছায়া যুদ্ধ করে চলেছে। তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগেই এ যুদ্ধ শেষ করতে কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু পরিকল্পনার কথা বলেননি। তবে ইউক্রেনকে চাপ দেওয়া বা রাশিয়াকে রাজি করানোর সম্ভাব্য সব উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ন্যাটো এবং রাশিয়ার অবস্থান বিপরীতমুখী।
ন্যাটোকে আরও শক্তিশালী করতে দেশগুলো কাজ করছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান ন্যাটোকে দুর্বল করার বিপরীতে রাশিয়াকে সুবিধাজনক স্থানে তুলে আনবে। সব মিত্রদেশকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট একা এই কঠোর অবস্থানে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতির সম্মুখীন হবে না, তবে ইউরোপের দেশগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। যদি দেশগুলো আরও বেশি অর্থ ন্যাটোর জন্য বরাদ্দ করে তাহলে সমস্যার সমাধান হতেও পারে। তবে সেসব তো আরও সামনের কথা। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ট্রাম্প নীতিতে মধ্যপ্রাচ্য রয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। ইরানের সব পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে কোনো সমাধান সহসাই আশা করা যাচ্ছে না। আগেও হয়নি, সামনেও হবে কি না বলা যাচ্ছে না। সৌদির সব ইসরাইলের একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ। এবার সেটা হতে পারে। হলে সেটা অবশ্য সফলতা হিসেবেই দেখা হবে। এসবের মধ্যেও ভাবাচ্ছে পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের মতামত। পানামা খাল দখল করার হুমকি দেওয়ার পর থেকেই বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এর আগে এ ধরনের কথা ওঠেনি। ট্রাম্প কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা উলেস্নখ করে গ্রিনল্যান্ড কেনার এবং পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ব্যাপারে তার বিতর্কিত ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন। এটা কঠোরভাবে ট্রাম্পকে সমালোচনায় ফেলে এবং প্রভুত্ববাদী মনোভাবের প্রকাশ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে সত্যিকারের গ্রেট করা থেকে হয়তো পিছিয়ে দিতে পারে। তবে সব সমালোচনা এড়িয়ে একলা চলো নীতিতে কতোটা সফল হবে সেটাই দেখার বিষয়।
\হ
অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট