হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিদ্যা, জ্ঞান, শিল্পকলা ও সঙ্গীতের দেবী হিসেবে আরাধ্যা দেবী সরস্বতী। বসন্ত পঞ্চমী এই দেবীর আরাধ্য তিথি। এই দিনটি উৎসবের- যা জ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সঙ্গমের প্রতীক হিসেবে বিবেচ্য। এটি নতুনের সূচনাক্ষণ এবং জ্ঞান অর্জনের দিন। বসন্ত পঞ্চমীর শুধু ধর্মীয় নয়, জ্যোতিষশাস্ত্রের দিক থেকেও তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনটি জ্ঞানের দেবী মা সরস্বতীকে উৎসর্গ করা হয়।
প্রশ্ন হতে পারে- কে এই দেবী? পুরাণ মতে, পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকারী রূপের নাম ব্রহ্মা আর ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম সরস্বতী। এর অর্থ হলো, দেবী সরস্বতীই ব্রহ্মা। ব্রহ্মা মানেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, অর্থাৎ সরস্বতীই পরমেশ্বর বা ঈশ্বর। জ্ঞানপিপাসুদের কাছে সরস্বতী জ্ঞানদায়িনী, কল্যাণ ও শান্তি বিধায়িনী। তিনি জাগতিক মোহ ধ্বংসকারী। বৈদিক সাহিত্যে মাতা সরস্বতী মূলত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। 'সরস' শব্দের অর্থ জল। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। সরস্বতী শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থে সরস+বতু আর স্ত্রী লিঙ্গে 'ঈ' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সরস্বতী। এছাড়াও, তিনি বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া নামেও অভিহিত। সরস্বতীর এক হাতে বীণা অন্য হাতে পুস্তক এবং তিনি হংসবাহনা।
সাহিত্যিক রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, আর্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, ওই নদী প্রথমে দেবী হিসেবে পূজিত হয়েছিল। বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকে তেমনি সরস্বতী হলো জ্ঞানের দেবী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উলেস্নখ আছে, গোলকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্ণী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী নদীরূপ পরিগ্রহ করে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হন। স্কন্দ পুরাণের প্রভাসখন্ডেও দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অধিষ্ঠানের কাহিনীতে বর্ণিত আছে। কাহিনিতে নদী সরস্বতীর ভৌগোলিক অবস্থানকে স্পষ্ট করা হয়েছে। বৈদিক জ্যোতিরূপা সরস্বতী ও নদী সরস্বতী সম্মিলিতভাবে জ্ঞানের দেবীরূপে পুরাণতন্ত্র ও সাহিত্যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তির অধিকারিণী হয়েছেন। পুরাণে বলা হয়েছে-'দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। তিনি বাক্য, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা ইত্যাদির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস্বতী পূজার প্রবর্তক ব্রহ্মা এবং শ্রীকৃষ্ণ।'
কোনো ভক্তকে সরস্বতী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তারা অবলীলায় বলবে, জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী। কেউ হয়তো বলবে, সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু হয় না। ঈশ্বরের একটা রূপের নাম এবং স্ত্রীলিঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরীরূপে সরস্বতীই পরমব্রহ্ম। দেবী সরস্বতী শুভ্রমূর্তি নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক। শিক্ষণীয় যে, আরাধনাকারী তার সব কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে। সরস্বতীর বাহন রাজহংস। প্রচলিত আছে, হংসবাহনা সরস্বতীর হংসকে দুধ ও জলের মিশ্রণ পান করতে দিলে সে অনায়াসে জল রেখে সারবস্তু দুধ গ্রহণ করে থাকে। অন্যদিকে, সার ও অসার মিশ্রিত জগৎ সংসারে মানুষ যেন সারবস্তুই গ্রহণ করে এমন নির্দেশনা পাওয়া যায়। সরস্বতীর হাতের পুস্তক জ্ঞানচর্চার প্রতীক। বলার অপেক্ষা রাখে না, জ্ঞানের মতো পবিত্র এ জগতে আর কিছুই নেই। এই জ্ঞান সব যোগেরও পরিপক্ব ফল। সংযতেন্দ্রিয় ও তত্ত্বজ্ঞানে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এই জ্ঞান লাভ করেন। সরস্বতী দেবীর হাতের বীণা সঙ্গীতবিদ্যার প্রতীক। অনেকে বলেন, হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই সরস্বতীর অপর নাম বীণাপাণি। সঙ্গীতের সুর মানুষকে বিমোহিত করে, আন্দোলিত করে। প্রাণে অপার আনন্দের সঞ্চার ঘটায়। সুরের লহরি শুনতে চায় না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। সরস্বতীর হাতের বীণা এই ইঙ্গিত দেয় যে, হিন্দুধর্ম নাচ-গান সমৃদ্ধ শিল্পকলার ধর্ম। এই বীণা হলো শিল্পকলার প্রতীক। প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে হিন্দুধর্ম সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে।
সরস্বতী শ্বেতপদ্মের ওপর উপবিষ্ট। সাধকদের মতে, মানব দেহে ছয়টি পদ্ম আছে। বিশুদ্ধ পদে আরোহণ করলে সারস্বত জ্ঞান লাভ হয়। সরস্বতীকে পদ্মাসীনা দেখিয়ে দেহস্থ প্রাণবায়ুকে উত্তোলন করার কৌশল নির্দেশ করা হয়েছে এতে। সরস্বতীর শুভ্রবর্ণ শুচিতা, শুভ্রতা, শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক- যা মানুষের মনকে শুচি, শুভ্র ও শুদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। পুরাণে বলা হয়েছে, সরস্বতী দেবীর সব সৌন্দর্য ও দীপ্তির উৎস ব্রহ্মা। পঞ্চ মস্তকধারী দেবী সরস্বতী। সরস্বতী পূজার একটি বিশেষ অর্ঘ্য পলাশ ফুল। মার্কন্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচন্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা। বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘণ্টা ছিল তার অস্ত্র। দেবীর এই সংহারলীলাতেও জ্ঞানভাবের হানি ঘটেনি। কেননা, তিনি 'একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা' বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈতজ্ঞান দান করেছিলেন। তবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছ থেকে পূজা পেয়েছেন সরস্বতী। অনেক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পাথরের ছোট ছোট সরস্বতী মূর্তি রক্ষিত আছে।
বিশ্বাস করা হয়, বসন্ত পঞ্চমীর দিন থেকে ঋতু পরিবর্তন হয় এবং ঋতুরাজ বসন্তের আগমন ঘটে। গাছের পুরনো পাতা ঝরে নতুন অঙ্কুর গজায়। কোকিলের তান আর মহুয়া ও অন্যান্য ফুলের সুবাসে গোটা পরিবেশ মুখরিত থাকে। তাই বসন্ত পঞ্চমীকে বলা হয়েছে প্রকৃতির উৎসব। এই দিন থেকে, সূর্যের রশ্মি শক্তিশালী হতে শুরু করে যাতে কনক ফসল অর্থাৎ গম সোনার মতো পাকে এবং গৃহ ধন-শস্যে ভরে যায়। ক্ষেতে হলুদ সরিষা ফুলের সৌন্দর্য বসন্ত পঞ্চমীর হলুদ রঙের প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত। এটি বছরের সেই বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে একটি, যেদিন পঞ্চাঙ্গের দিকে না তাকিয়ে যে কোনো শুভ কাজ করা যেতে পারে। এই দিনে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিশেষভাবে অনুকূল থাকে। বসন্ত পঞ্চমীর দিন, চাঁদও একটি শুভ অবস্থানে থাকে, যা মানসিক শান্তি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি নিয়ে আসে। এই দিনে হলুদ কাপড় পরিধান করা হয়- যা বৃহস্পতি গ্রহের প্রতীক এবং জ্ঞান, শুভ ও সৌভাগ্য নিয়ে আসে।
সরস্বতী চতুর্ভুজা হলেও আধুনিককালের সরস্বতী হয়েছেন দ্বিভুজা। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, 'দ্বিভুজা বীণাপাণি সরস্বতী গত ১৫০ বছরের মধ্যে কল্পিতা হয়েছেন।' সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। বর্তমানে মানুষ নানাভাবে, লোভের বশবর্তী হয়ে, অজ্ঞাতসারে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, জ্ঞানের আলো অন্ধকার দূর করে। 'সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে/ বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যংদেহী নমোহস্তুতে'। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এভাবেই জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে। তারা প্রত্যাশা করে, জীবের অন্তঃস্থলের সব অন্ধকার দূরীভূত হয়ে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ তার মনের কলুষতা দূর করে জ্ঞানের আলোয় নিজেকে ও অন্যকে আলোকিত করুক, দেবী সরস্বতীর কাছে এমন প্রার্থনা দোষের নয়।
বীরেন মুখার্জী : কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী