রাজতন্ত্রের অচলায়তন ভেঙে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপস্নব থেকে সমাজতন্ত্রের ইতিহাসের গোড়াপত্তন। তবে, ফরাসি বিপস্নবের মূল লক্ষ্য সমাজতন্ত্র না হলেও এই বিপস্নবই ছিল সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার। ১৯৭০ দশকে আধুনিক পুঁজিবাদের উত্থানে পতন ঘটতে থাকে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের। আর তার স্থলে রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গণতন্ত্র। শাসন পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের সূচনা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সুষ্ঠু সুন্দর রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র মানুষকে নবতর দিশার সন্ধান দিয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪২২ অব্দে ক্লিয়ান গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এই বলে যে- 'সেটাই হবে গণতান্ত্রিক- যা হবে জনগণ, জনগণের জন্য'। তার অনেক পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর পেনসেলভিনিয়া গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, 'গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য।' বর্তমানকালে গণতন্ত্র শব্দটি দ্বারা এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা এমনকি এক বিশেষ অর্থব্যবস্থাকেও বোঝানো হয়। সাম্য হলো গণতন্ত্রের মূলভিত্তি। সমাজব্যবস্থায় সাম্য, রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাম্য, শাসনব্যবস্থায় সাম্য এবং অর্থব্যবস্থায়ও সাম্য বিরাজমান থাকলে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। সাম্যের ভিত্তিতে যেই সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবাই সমমর্যাদাসম্পন্ন। সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে সবার সম-অধিকার বলবৎ থাকে; ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয় না। বলপ্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। সামগ্রিক উন্নয়ন, বিকাশ, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে সবার প্রচেষ্টাকে সমান সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সব ব্যক্তি একই রকম না হলেও সবাই সমান। রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রের অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে, 'রাইট টু পিপল' অর্থাৎ জনগণের অধিকার। যেখানে জনগণের মতের ওপর ভিত্তি করে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অধ্যাপক গেটেলের মতে, 'যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী, তাই গণতন্ত্র।' বিশ্বে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ১৮২৮ সাল থেকে ১৯২৬ সাল সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল।
১৯৯২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা 'ইতিহাসের সমাপ্তি' টেনে 'উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিজয়' ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই বিজয় মাঝপথে ঝিমিয়ে পড়ছে। ইআইইউ'র প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের মাত্র ২৪টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র, ৫০টিতে ত্রম্নটিপূর্ণ গণতন্ত্র, ৩৪টিতে হাইব্রিড আর ৫৯টিতে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র বলবৎ আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। আর এই গণতন্ত্র সংকোচনের পেছনের কারণও কিন্তু অতি গণতন্ত্রায়ণ। ১৯৭৫ সালে ত্রিপক্ষীয় কমিশনের জন্য মিশেল ক্রোজিয়ার, স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন ও জোজি ওয়াতানুকি 'দ্য ক্রাইসিস অব ডেমোক্রেসি : অন দ্য গভর্নেবিলিটি অব ডেমোক্রেসিস' নামক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসনের সমস্যাগুলো 'গণতন্ত্রের আধিক্য থেকে উদ্ভূত হয়'। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপের সরকারগুলো 'অংশগ্রহণকারী ও তাদের দাবি-দাওয়াতে নু্যব্জ' হয়ে পড়ে, এতে করে উচ্চ আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিষয়াদির পরিচালনায় অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়- যা তাদের সমাজকে অশাসনযোগ্য করে তুলেছে। গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা চার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান লন্ডনের ইআইইউ, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম হাউস, সুইডেনের 'ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিসটেন্স' ও ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের দুরবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অব্যাহত অবনমন বা পশ্চাৎযাত্রাকে ল্যারি ডায়মন্ড 'গণতান্ত্রিক মন্দা ও ক্রান্তিকাল' হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বে এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর গণতন্ত্রের সূচক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ৫টি বিষয় বিবেচনা করা হয়। সেগুলো হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিক স্বাধীনতা। পৃথিবীজুড়ে বিরাজমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এই পাঁচটি বিষয়ের নিদারুণ অবমন প্রকট হয়ে ওঠেছে। সাধারণ ধারণা হলো, জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। ২০০৬ সালের পর থেকে গণতন্ত্র সূচকের এই পশ্চাৎপদতা ও স্থাবিরতা অব্যাহত আছে। ভি-ডেমের প্রতিবেদনমতে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ অর্থাৎ ৫৭০ কোটি মানুষ স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করছে। বিশ্বের ১৭৩টি দেশের মধ্যে ৮৫টি দেশে গণতন্ত্র সংকটের মুখে আছে। ২০২৩ সালে ফ্রিডম হাউসের প্রকাশিত 'বিশ্বে স্বাধীনতা-২০২৩: গণতন্ত্রের সংগ্রামে ৫০ বছর পূর্তি' শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, টানা ১৭ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়ার কারণে গণতন্ত্রের ধারাবাহিক অবনমন ঘটছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ) মানুষ কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করে, যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্রে বাস করে মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। জার্মানির ব্যার্টেলমান ফাউন্ডেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ীও বিশ্বে দুর্বল প্রশাসন ও গণতন্ত্রের সংকট দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাজার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেওয়া বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ক্ষমতার আধিক্য ও দুর্নীতির প্রভাব সর্বজন স্বীকৃত। কারণ এই পুঁজিবাদী অর্থনীতি রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থাকে অন্যায্য ও অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করছে। যার ফলে, রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক অবয়ব ও আদর্শ থেকে ক্রমান্বয়ে সরে যাচ্ছে। এতে রাজনৈতিক সততা ও গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী- দেশ ও দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা, নেতাদের আমলাতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগের পরও নেতা পরিবর্তনের কোনো প্রক্রিয়া না থাকা এবং ক্রমাগত দুর্নীতির বিস্তার। যে কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি শুধু আমলাশ্রেণি ও প্রতিষ্ঠানই কলুষিত করে না, সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানসমূহকে- যেমন স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন পুলিশ বিভাগ, স্বাধীন গণমাধ্যম ইত্যাদিকে পঙ্গু করে দেয়। এতে করে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিজম, পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতিতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে। গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলোর অধঃপতন, নীতিহীনতা, বিরোধীদের ক্ষমতায় আসতে না দেয়া, জনপ্রতিনিধিদের কেনাবেচা- যা গণতন্ত্রের শৌর্যবীর্যকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। ফলে, গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে, বিভিন্ন দেশে অতি-দক্ষিণপন্থিরা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মোড়কে ফ্যাসিবাদকে রুখতে মানুষ বিকল্প খুঁজছে, ঝুঁকছে সাম্যতন্ত্রের দিকে। এঙ্গেলস এই বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে ভিন্ন এক বিপস্নবী গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, যে গণতান্ত্রিক বিপস্নবের নেতৃত্ব দেবে সর্বহারা শ্রেণি। ১৯৪০ সালে মাও সে-তুং যাকে নয়া-গণতন্ত্র বলে তত্ত্বাবধায়ন করেছেন। এই তত্ত্বের মুখ্য দিক হলো- 'জাতীয় সমস্যার মূল বিষয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এখন আর সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ নয়, তা এখন সাধারণ সর্বহারা, সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবেরই অংশে পরিণত হয়েছে।' বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র সমাজে বিভাজনকে টিকিয়ে রেখে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানে একটা আপাত সমতাকে তুলে ধরে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ক্ষমতাসীন থাকে বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্ব। পুঁজিবাদ যেখানে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ করে, কিন্তু উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিকানা থাকে বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে সেখানে সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের উপায়সমূহও সামাজিকীকরণ করা হয়। অপরদিকে, কেবল সাম্যবাদী শ্রেণিহীন সমাজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র যেখানে রাষ্ট্র কার্যকর থাকে না। তাছাড়া, গণতন্ত্রকে ধারণ ও আচরণ করবার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাব গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বড় বাধা। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্রকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিন্তু গণতন্ত্র যে ন্যায়পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন ও মনস্তাত্ত্ব্বিক পরিশুদ্ধতা এবং ধারণ ও আচরণের বিষয়ের কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। কারণ রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের বিষয়টিকে বিভিন্ন রঙে-রূপে প্রচারে বিমোহিত করে রাখে। এতে করে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণের কাছে প্রচ্ছন্নই থেকে যায়। ফলে, গণতন্ত্র তার দিশা হারিয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে রাষ্ট্র ও জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পায় না। তাই, গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জরুরি আর এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের মূলভিত্তি সুশাসন জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকর করা। অন্যথায় সর্বহারা নিপীড়িত মানুষ বিপস্নবী গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটতে বাধ্যও হতে পারে।
অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট