বর্ণ বা অক্ষরের উৎপত্তি

বাংলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপি থেকে। তাছাড়া বাংলা লিপি ও অক্ষর উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মীলিপির মাধ্যমে। ব্রাহ্মীলিপি ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন লিখন পদ্ধতির নাম। এটি একটি শব্দীয় বর্ণমালা রীতি, যেখানে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা হয়ে ছিল। ব্রাহ্মীলিপি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করে সম্রাট অশোকের আমলে। সম্রাট অশোকের আমলের পাথর খোদাই করা বালীতে ব্রাহ্মীলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। আর এই ব্রাহ্মীলিপি থেকে বাংলা বর্ণের উৎপত্তি ঘটে।

প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
পৃথিবীতে মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। সারা পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা ৭০৯৯টি। প্রতিটি ভাষাই একটি নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে লেখা হয় যাকে বর্ণমালা বলে। মানুষ যে ধ্বনি উচ্চারণ করে মনের ভাব প্রকাশ করে তা বর্ণ বা অক্ষর দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। পৃথিবীতে ব্যবহৃত ভাষাগুলোর লিপিবদ্ধতার বর্ণ বা অক্ষর কবে বা কোন ভাষার বর্ণ বা চিহ্ন প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না যে অমুক ভাষার বর্ণ বা অক্ষর পৃথিবীতে প্রথম প্রচলন ঘটে। তবে নানা ধারণাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে একটি ঐকমত্য পোষণ করা যায় যে, প্রাচীনকাল হতে পাঁচটি স্তর পার হয়ে আধুনিক বর্ণমালা বা অক্ষরমালা এসেছে। পৃথিবীতে যখন কোনো বর্ণ বা অক্ষরমালা ছিল না, তখন মানুষ, গাছপালা, মানুষ প্রাণীর ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। এটা হচ্ছে বর্ণমালার প্রথম স্তর যাকে গ্রন্থিলিপি বলা হয়। আনুমানিক পনের কি বিশ হাজার বছর পূর্বে মানুষ গ্রন্থিলিপি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করত। এই বিষয়টিকে একটু সংক্ষেপে করার জন্য মানুষ মনের ভাব প্রকাশে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার শুরু করে। তখন সম্পূর্ণ ছবি না এঁকে সংকেত বা চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা শুরু করে, একে ভাবলিপি বলা হয়। ভাবলিপিটা ছিল এমন, তা হলো দিন বুঝাতে সূর্য আঁকত, রাত বুঝাতে অর্ধবৃত্তের সঙ্গে তারা একে রাতকে প্রকাশ করত। তার পরবর্তী পর শুরু হয় চিহ্ন দ্বারা বিভিন্ন শব্দকে বুঝানো। যাকে শব্দলিপি বলা স্তর বলা হয়। এ পর্যায়ে এসে শব্দলিপির চিহ্নগুলোকে আরেকটু সংক্ষেপে করে প্রকাশ করতে শুরু করে যাকে চতুর্থ স্তর বলা হয়। এই সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা চিহ্নকে বলা হতো অক্ষর লিপি। পরবর্তীতে অক্ষর লিপির চিহ্নগুলোকে একটু সুন্দর নকশায় রং ও বর্ণ দিয়ে লেখা শুরু হয়, সেই সময় এটাকে বলা হতো ধ্বনি লিপি। এই ধ্বনি লিপি থেকে আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। আর এই চিহ্নগুলোকে বর্ণমালা বা বর্ণ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। বর্ণমালা বির্বতনের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যায়, একটি হলো সেমিটিক ভাষি মানুষ, সম্ভবত ফিনিশিয়ানরা ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে খৃষ্ট জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর আগে ব্যঞ্জবর্ণ লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল উত্তর সেমিটিকে। দ্বিতীয়টি আবিষ্কার হয়েছিল গ্রিকদের দ্বারা। এটা ছিল স্বরবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করা অক্ষর আবিষ্কার করে। এই আবিষ্কারটি হয়েছিল খৃষ্ট জন্মের প্রায় ৮০০ থেকে ৭০০ বছর আগে। কিছু পন্ডিত সেমেটিক লিখন পদ্ধতিকে একটি অবাঞ্চিত পাঠ্যক্রম এবং গ্রিক পদ্ধতিকে প্রকৃত বর্ণমালা মনে করেন। তবে উভয়টিকে বর্ণমালার রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্ণমালার উৎস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা হয়েছে। গ্রিক ও রোমানরা পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে বর্ণমালার সম্ভাব্য উদ্ভাবক হিসাবে বিবেচনা করেছিল। তারা হলো ফিনিশিয়ান, মিশরীয়, অ্যাসিরিয়ান, ক্রেটান ও হিব্রম্ন। আধুনিক গবেষণায় যা পাওয়া যায় তা প্রাচীন তত্ত্বের সঙ্গে খুব বেশি পাথর্ক্য নয়। যদিও লক্ষণগুলোর বাহ্যিক রূপ উপেক্ষা করা হয় এবং শুধু ধ্বনিগত মান, সংখ্যা এবং ক্রম বিবেচনা করা হয় তা হলে হিব্রম্ন বর্ণমালা প্রাচীন। কিছু পন্ডিতরা হিব্রম্ন ক্রমটিকে প্রাচীন হিসেবে মনে করেন, যা ৩ হাজার ৫শত বছর আগে আধুনিক রূপ নিয়েছিল। হিব্রম্ন বর্ণমালাকে পদ্ধতিগতভাবে প্রাচীনকালে শেখানো হতো তার প্রমাণটি পাওয়া যায় দক্ষিণ ইসরাইলের তেল লাখিশের প্রসাদে। তেল লাখিশের প্রসাদের দিকে যেতে সিড়ির ওপরে পাঁচটি অক্ষরে ক্র্যাচ করা। তা ছিল হিব্রম্ন অক্ষর। আরমাইক ভাষার সঙ্গে উত্তর সেমেটিক বর্ণমালার অভিযোজন ঘটেছিল খৃষ্ট জন্মের ১০ শতক বছর পূর্বে। যখন উত্তর মেসোপটোমিয়া এবং সিরিয়ার কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজ্যর মানুষ আরামাইক ভাষায় কথা বলত। যার মধ্যে অন্যতম দামেস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য। সামগ্রিকভাবে যে কয়েকটি আরামিক শিলালিপি পাওয়া গেছে তা ৭তম থেকে ৯ম শতাব্দীর মধ্যে। ষষ্ঠ শতাব্দীর কিছু শিলালিপি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে আরমাইক বর্ণমালার দ্রম্নত বিস্তার ঘটে। আরামাইক প্যাপরি এবং অষ্ট্রাকা (লিখিত মৎপাত্রের টুকরো) এগুলোতে যে তারিখ উলেস্নখিত তা খৃষ্ট জন্মের ৫১৫ বছর আগের। এলিফ্যান্টাইন প্যাপরিতে দেখা যায়, হিব্রম্ন সামরিক ও ধর্মীয় উপনিবেশের তথ্য। সেখানে হিব্রম্ন জাতির অর্থনৈতিক তথ্য রয়েছে। উত্তর আরব, প্যালেস্টাইন, লিবিয়া, ক্যাপাডোসিয়া, লিডিয়া, সিলিসিয়া, অ্যাসিরিয়া, গ্রীস, আফগানিস্তান এবং ভারত পর্যন্ত আরামাইক শিলালিপি পাওয়া গেছে। সিরিয়ার পশ্চিমে সমস্ত বর্ণমালার লিপিগুলি উৎপত্তি হয়েছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কেনানাইট বর্ণমালা থেকে। এখানে শত শত বর্ণমালার লেখা দৃশ্যত আরামাইক বর্ণমালার শাখা থেকে উদ্ভুত। সামগ্রিকভাবে, আরামাইক বর্ণমালার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বংশধরদের দুইভাবে বিভক্ত করা যায়। একটি সেমেটিক ভাষার জন্য লিপি, অন্যটি অসেমেটিক ভাষায় অভিযোজিত। মেসেটিক শাখাটির ক্ষেত্রে, ছয়টি বর্ণমালা সনাক্ত করা যায়, যেমন . হিব্রম্ন, নাবাতিয়ান-সিনাইটি,আরবি-পালিমারিণ, সিরিয়াক-নেষ্টুরিয়ান, ম্যান্ডিয়ান এবং ম্যানিচিয়ান। এর মধ্যে কিছু বর্ণমালা আরামাইক বর্ণমালা এবং মধ্য, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ায় অসেমেটিক ভাষার জন্য ব্যবহৃত লিপির মধ্যে যুগসূত্র গড়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ বা প্রধানত পরোক্ষভাবে আরামাইক বর্ণমালা থেকে অ-সেমেটিক ভাষার সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছিল যে, বর্ণগুলোর সেই ভাষাগুলো হওলা। ফার্সি :ইরানি স্ক্রিপ্ট হিসেবে পরিচিত পাহলভি, যা প্রাক ইসলামিক ফারসি সাহিত্যের মতো লেখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সোগদিয়ান :- একটি লিপি এবং ভাষা যা প্রথম সহস্রাব্দে, দ্বিতীয়ার্ধে মধ্য এশিয়ার ফ্রাঙ্কো ভাষা গঠন করেছিল। কোক তুর্কী : মধ্য সাইবেরিয়ার দক্ষিণ অংশে, উত্তর-পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায় এবং উত্তর-পূর্ব তুর্কিস্তানে বসবাসকারী তুর্কি উপজাতিদের দ্বারা ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতাব্দীর মধ্যে ব্যবহৃত একটি লিপি (এই বর্ণমালাটি প্রাথমিক হাঙ্গেরিয়ান বর্ণমালার নমুনা ছিল)। উইঘুর বর্ণমালা, তুর্কিভাষি মানুষ যারা ১৩ শতাব্দীর প্রথমদিকে মঙ্গোলিযার ও পূর্ব তুর্কিস্তানে বসবাস করত। এই লিপিটি তিব্বতীয় প্রভাবের সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছিল। মঙ্গল সাম্রাজ্যের লেখা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল কলিকা লিপি। কাল্মিক, বুরিয়াট, মঙ্গেলিয়ান প্রপার এবং সহযোগী মাঞ্চু বর্ণমালার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে মঙ্গলদের বর্ণমালার জন্ম হয়। আরামাইক র্বণমালা সম্ভবত ভারতের ব্রাহ্মীলিপির নমুনাও ছিল। এটি প্রায় ভারতীয় সব অঞ্চলের লেখার মূল হয়ে ওঠে। বাংলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপি থেকে। তাছাড়া বাংলা লিপি ও অক্ষর উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী লিপির মাধ্যমে। ব্রাহ্মীলিপি ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন লিখন পদ্ধতির নাম। এটি একটি শব্দীয় বর্ণমালা রীতি, যেখানে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা হয়ে ছিল। ব্রাহ্মী লিপি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করে সম্রাট অশোকের আমলে। সম্রাট অশোকের আমলের পাথর খোদাই করা বালীতে ব্রাহ্মীলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। আর এই ব্রাহ্মী লিপির থেকে বাংলা বর্ণের উৎপত্তি ঘটে। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত জ্ঞানসম্পন্ন ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে একে ব্রাহ্মীলিপি বলা হয়। সংস্কৃত বর্ণমালার সেমেটিকএর অভিযোজনাংশ। ব্রাহ্মী লিপি উত্তরী ও দক্ষিণী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী লিপিগুলোর মধ্যে প্রচলিত ছিল ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীর পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি। এই গুপ্তলিপি থেকে ৬ষ্ঠ হতে ৯ম শতাব্দীতে আবির্ভাব হয় কুটিল লিপি বা সিদ্ধ মাতৃকা লিপির। সিদ্ধ মাতৃকা লিপির পরির্বতন হয়ে জন্ম দেয় প্রটো-বাংলা লিপির। এই লিপিতে বাংলা লিপির বর্তমান চেহারার প্রথম সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তাই একে বলা হয় প্রটো-বাংলা বা গৌড় লিপি। ওই সময় যে বর্ণগুলো ছিল তার চেহারা বর্তমান বাংলার হুবুহু মিল পাওয়া যায়, যা আমরা ব্যবহার করি; যেমন- ঈ, ঈ, উ,ঊ, ট র্বণগুলো।, তবে ওই সময় এই বর্ণগুলোর ওপরের লেজ ছিল না। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের ৭ম শতকে যোগ চিহ্নের মতো ক বর্ণটি ত্রিকোণার রূপ নেয়। ডান দিকে বক্ররেখা যুক্ত হয়, যা বাংলা 'ক' বর্ণের প্রাথমিক রূপ ধরা পড়ে। আবার ব্রাহ্মীর 'র' বর্ণটি ছিল একটি উলস্নম রেখার মতো। এই যুগেই 'র' বর্ণটি ত্রিকোণা রূপ লাভ করে। তবে 'র' এর নিচে সেই সময়কার কোনো বিন্দু দেখা যায় নাই। 'থ'-এর মধ্য ভাগটি একটু স্ফিত হয় এবং শির ভাগে একটি পুটলি দেখা যায়। অনুরূপ 'ফ'-এর ডানদিকে একটি পুটলি যুক্ত হয়ে 'ফ' র্বণটির উদ্ভব হয়। নাগরী লিপি বা উত্তর নাগরী লিপি হলো দেবনাগরীর রূপের পূর্ব পুরুষ, বাংলা লিপিতে উত্তর ভারতীয় নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে। এর ফলে পূর্ব ভারতীয় লিপি নতুন চরিত্র লাভ করে। একে লিপি বিদ্যাবিশারদগণ 'প্রাটো-নাগরী' লিপি বলে অভিহিত করেছেন। এ সময় লিপি পরির্বতনের মূলে ছিল পাল রাজবংশের শাসনকাল। পাল রাজবংশের শাসকাল ছিল ৭৫০ থেকে ১১৬১ সাল পর্যন্ত। সেন যুগের প্রথম দিকে বাংলা লিপির বির্বতনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ্য করা যায়। বিজয় সেন ও বলস্নাল সেনের শাসনামলে পান্ডুলিপি ও তাম্রলিপিতে প্রোটো-বাংলার বহুল প্রচলন ছিল। ওই সময় বহু বর্ণ অবিকল বাংলার বর্তমান বর্ণের ন্যায় লেখা হতে থাকে। 'ই', 'ঈ', 'উ', 'ঊ', 'ট'- এই ধরনের বর্ণগুলো আলংকারিক উড়ি ছাড়া অবিকল বর্তমান বাংলা বর্ণের মতো ছিল। তবে সেন ও চন্দ্র লিপি মালায় ঈ বর্ণের ব্যবহার দেখা যায়। চ বর্ণটি প্রোটো-বাংলায় নতুনরূপে পরিবর্তিত হয়, এর আগে চ বর্ণের বক্রাকার রেখাটি বাম দিকে ছিল। কিন্তু প্রোটো-বাংলায় তা ডান দিকে চলে আসে। এছাড়া, প্রোটো-বাংলায় ক্ষ, ঙ্গ, ঞ্জ, চ্ছ, ঞ্চ, যুক্তাক্ষরগুলো বাংলা অক্ষরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকে। লক্ষণ সেনের আনুলিয়া তাম্রশাসনে বাংলা লিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য পরিষৎ-এর লিপিতে বাংলা লিপির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়। ডোম্মনপালের সুন্দরবন তাম্র লিপিটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাংলা অক্ষরে উৎকীর্ণ, যার সময়কাল ১১৯৬ সাল। বারো শতকের পর আর কোনো বাংলা তাম্রলিপি পাওয়া যায়নি। তবে তের শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতক পর্যন্ত বাংলা পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। এসব পান্ডুলিপিতে বাংলা পান্ডুলিপির পূর্ণাঙ্গরূপ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খালিমপুর তাম্রলিপি, দেবপালের মুঙ্গের তাম্র শাসন এবং প্রথম মহীপালের সারানাথ লিপিতে 'প্রোটো-নাগরীর' লিপির প্রচলন দেখা যায়। ময়মনামতি আদিবে রাজাদের লিপিতে ও চন্দ্রলিপিতে প্রোটো-নাগরী লিপির প্রভাব প্রতিফলিত হয়। ৯ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে দশম শতক পর্যন্ত সারা বাংলায় জুড়ে, তখন প্রোটো-বাংলার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মহীপালের বানগড় লিপি, নারায়ণপালের গরুড় স্তম্ভলিপি এবং বিগ্রহপালের আমগাছি লিপিতে প্রটো-বাংলার লিপির ব্যবহার করা হয়। পাল যুগের পান্ডুলিপি 'অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা এবং সন্ধাকর নন্দীর রাম চরিত গ্রন্থে' যে লিপি ব্যবহার করা হয় তা ছিল প্রোটো-বাংলা। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা হলো, শ্রীমন্তের শিক্ষারাম্ভ থেকে ষোড়শ শতকের বাংলায় শিশু শিক্ষার সূচনাপর্ব। পাঁচ বছরের শিশুকে গুরুর পাঠশালায় হাতেখড়ি দেওয়া হতো। এই পাঠশালায় শিশুরা গুরুর কাছ থেকে মুখে মুখে হাতে লেখা পুথি থেকে নীতি, জমিজমা ও ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব নিকাশ, বাক্য, শ্লোক ইত্যাদি মুখস্ত করত। তখনো মুদ্রণ যন্ত্র বাংলায় স্থাপিত হয়নি আর একটি বিষয় তখন লক্ষ্য করা যায় যে, ইংরেজদের আবিষ্কৃত মুদ্রণ যন্ত্রে বাংলার ব্যবহার করলে তা হবে জাত যাওয়ার শামিল। তবে এই কুসংস্কারটি কেটে যায় অল্প সময়ের মধ্যে। রাধাকান্ত দেব রচিত 'বাঙ্গালা শিক্ষা' গ্রন্থে বর্ণমালা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের সমাবেশ ঘটে। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮২১ সালে। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২৮৮। এত বড় বইটি প্রাথমিক বা শিক্ষা জীবন শুরুর জন্য উপযুক্ত ছিল না। বাংলা ভাষায় বাঙালির শিক্ষাদীক্ষার পটভূমি বিচার করলেই বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় বইটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিশুদের বর্ণ পরিচয় রচনার গোড়ায়ই এসে পড়ে বর্ণমালার কথা। ব্রাহ্মীলিপি থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। এই বির্বতন প্রক্রিয়া চলে প্রায় তিন হাজার বছরও বেশি সময়কাল। তবে এটা সর্বজন স্বীকৃত যে বিদ্যাসাগরের হাতেই বাংলা বর্ণের যথাযথ উন্নতি হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার যে মৌলিক উন্নয়ন ঘটেছে তার প্রায় দেড়শত বছর একইভাবে চলেছে। তবে এই সময়কালে সামান্য কিছু সংস্কার করা হয়। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার প্রকৃতি ও সংখ্যা নির্ধারণ করেন। ১৭৬৮ সালের হালহেডের বইয়ের স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬টি। পরবর্তীতে প্রায় একশত বছর মদনমোহনের শিশু শিক্ষা প্রথম ভাগে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬টিই। এগুলো হলো অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋৃ, ৯,, এ, ঐ, ও, ঔ, অং, অঃ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২টিতে নামালেন। তিনি তার এই কমানোর ভূমিকায় লিখেছিলেন, 'বহুকালবধি বর্ণমালায় ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন- এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষায় দীর্ঘ ঋৃ-কার ও দীর্ঘ -কারের প্রয়োজন নাই। এই নিমিত্তে এই দু'টি র্বণ বাদ দেওয়া হয়েছে। আর সবিশেষ অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণের মধ্যে পরিগণিত হতে পারে না। তাই এই বর্ণগুলো ব্যঞ্জন বর্ণে পঠিত হয়েছে। চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনবর্ণের স্থানে স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ড, ঢ, য- এই তিন বর্ণের ব্যঞ্জন বর্ণে পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকলে ড়, ঢ়, য় হয়। বিদ্যাসাগরের মৌলিক সংস্কারের পর ১২৫ বছরে মাত্র একটি সংস্কার করা হয়েছে। তা হলো স্বরবর্ণ থেকে ৯ বর্ণটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন স্বরবর্ণ ১১টি, ব্যঞ্জন বর্ণ ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুন করে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেন। অনুস্বার বিসর্গ স্বর বর্ণ থেকে ব্যঞ্জন বর্ণে এনে তার সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু যোগ করে দিলেন। তাছাড়া ড, ঢ, য বর্ণের দ্বিবিধ উচ্চারণের জন্য নিচে ফুটকি বা শূন্য জুড়ে দিলেন। এতে তিনটি ব্যঞ্জন বর্ণের আবিষ্কার হলো। তাছাড়া বিদ্যাসাগার বাংলা ভাষা আকারে ত, ৎ দ্বিবিধ কলেবরে প্রচলিত আছে। তাই ৎ-কে ব্যঞ্জন বর্ণে সংযুক্ত করেন। যেহেতু ক্ষ অক্ষরটি ক ও ষ-এর মিলনে হয়, তাই তিনি ব্যঞ্জবর্ণ থেকে ক্ষ অক্ষরটি বাদ দিলেন। এভাবে বিদ্যাসাগরের হাতে ব্যঞ্জবর্ণ হলো ৪০টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণের ৯ এর মতো শুধু অন্তস্থা ব বর্ণটি বাদ দেওয়া হয়। এখন ব্যঞ্জন বর্ণ ৩৯টি। নানা তথ্য উপাত্ত অনুসারে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এভাবেই বর্ণ বা অক্ষরের উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলামিস্ট