দশম গ্রেড না দেওয়া ন্যায়ের পরিপন্থি

একটি সভ্য, আদর্শ জাতি গঠনের জন্য সাহসী, সত্যবাদী, মেরুদন্ড সম্পন্ন মেধাবী শিক্ষক প্রয়োজন।

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
একটা ছোট্ট গল্প দিয়েই শুরু করি। গল্পটি হলো- এক দেশে কিছু বুদ্ধিজীবী মিলে একটি পাখি ধরলেন। তারা পাখিটিকে রাখলেন চারদিকে উঁচু দেয়ালবেষ্টিত একটি স্থানে, যেখানে কোনো ছাদ ছিল না। একটু পরেই পাখিটি উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। চিন্তিত বুদ্ধিজীবীরা আলোচনায় বসলেন। পাখিটি উড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে আলোচনা চলল। অনেক আলোচনার পর তারা সবাই একমত হলেন, চারদিকের দেয়াল যথেষ্ট উঁচু না হওয়ায় পাখিটি উড়ে গেছে। এরপর পাখি ধরলে দেয়াল আরও উঁচু করতে হবে। গত ৫৩ বছর যাবত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নানা মত নানা আলোচনার ভিত্তিতে শিক্ষকদের পাহারা জোরদার করা হয়েছে এই পাখির গল্পের মতোই। কর্মকর্তা বেড়েছে, ভিজিট বেড়েছে, শিক্ষকদের শ্রেণি বহির্ভূত কাজ বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার মান খুব একটা বাড়েনি। একটা ট্রেনিংয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একজন ঊর্ধ্বতন বলেছিলেন, 'এই বিস্কুট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভিটামিন দিয়ে তৈরি। এটা খাবার পর শিশুদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে। অন্যদিকে, তারা বুদ্ধিমান হবে। এখন আপনারা যদি শিশুদের ঠিকমতো লেখাপড়া না করান তাহলে এদের পুষ্টি হলো, বুদ্ধি হলো কিন্তু শিক্ষার আলো না থাকার কারণে এরা ভয়ংকর সন্ত্রাসী বা অপরাধী হয়ে বেড়ে উঠবে।' রাষ্ট্র শিশুদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে কিন্তু শিশুদের শিক্ষা দিয়ে মানবিক গুণসম্পন্ন তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। অবকাঠামোগত কোনো সুযোগ-সুবিধা এমনকি পাঠ্যপুস্তক না থাকলেও শুধু শিক্ষক আর শিক্ষার্থী থাকলেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া শেষ করে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক ১৭,৬৩০/- টাকা বেতনে কেন শিক্ষকতা করবেন সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। অন্যান্য পেশায় পদোন্নতি আছে তরতর করে উপরে উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় একজন শিক্ষক যার পরিচয় তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, তিনি যে পদে চাকরি জীবন শুরু করেন সে পদেই অবসরে যান। গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে ৩০,০০০/- টাকার কম বেতনে তাদের সংসার চলছে না অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংসার এই বেতনে কি করে চলবে তা নিয়ে ভাবা কি উচিত নয়? বরং শিক্ষকদের কাজের ফাঁকি ধরার জন্য নিত্য নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন একটা 'এ' ক্যাটাগরি দৈনিক পত্রিকার ঝাড়ুদারের সমতুল্য। শিক্ষকদের টিফিন ভাতা ৬.৬৬ টাকা। এ লজ্জা কি শিক্ষকের না রাষ্ট্রের? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেড উন্নীতকরণের কথা এলেই সবচেয়ে বেশি যে কটাক্ষ শুনতে হয় তা হলো, এসএসসি পাস মাস্টার! এবার আসুন দেখি প্রাথমিকের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা (২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখ বিকাল ৪:৩৫ এ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া) : মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা- ৬৫ হাজার ৫৬৭টি, কর্মরত মোট শিক্ষক- ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৯৮১ জন। এরমধ্যে- এসএসসি পাস - ১১ হাজার ৭৩৬ জন, এইচএসসি পাস - ৫৩ হাজার ১৪৪ জন, ম্যাটস- ৩৮ জন, নার্সিং- ১৬ জন। বাকি ৩ লাখ ২০ হাজার ৪৭ জন শিক্ষক কমপক্ষে স্নাতক পাস। এরমধ্যে- পিএইচডি/এমফিল ডিগ্রিধারী রয়েছেন- ৩৬ জন। মাস্টার্স পাস রয়েছেন- ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৯ জন। স্নাতক (সম্মান) - ২১ হাজার ৪৩৫ জন। স্নাতক (পাস) - ১ লাখ ৪ হাজার ৬১ জন। এমবিএ ডিগ্রিধারী - ৫ হাজার ৯২৪ জন। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং - ১ হাজার ৪৫৮ জন। বিএসসি ইন অ্যাগ্রিকালচার - ৩০৯ জন। বিএসএস ডিগ্রিধারী ১০ হাজার ৮৫ জন। আরিফ মাহমুদ লিখেছেন : 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল দুটি বানরের ওপর একটা এক্সপেরিমেন্ট করে। পাশাপাশি দুটি সেলে দুটো বানরকে রাখা হয়। এরপর একটা বানরের সেলে একটা নুড়ি পাথর ছুড়ে প্রথম বানরটিকে বলা হয়- পাথরটি নিয়ে আসার জন্য। পাথরটি নিয়ে এলে শসার একটা টুকরো বানরটিকে দেয়া হয় আর এতে বানরটি আনন্দে লাফাতে থাকে। এবার দ্বিতীয় সেলের বানরটিকেও একটি পাথর দিয়ে বলা হয় পাথরটি নিয়ে আসা যাওয়ার জন্য। সে যখন নিয়ে আসে তখন তাকে একটি লাল আঙুরের থোকা দেয়া হয়। যা শসার চেয়ে অধিকতর সুস্বাদু। এটা দেখার পর প্রথম বানরটির মন ক্ষুণ হয় এবং শসার প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়। দ্বিতীয়বার পাথর ছুড়ে যখন প্রথম বানরটিকে নিয়ে আসতে বলা হয়। সে খুবই আশাবাদী হয় যে, পাথর ফেরত দিলে এবার নিশ্চয়ই তাকেও লাল আঙুরের থোকা দেয়া হবে। কিন্তু এবারও তাকে শসার টুকরো দেয়া হলে বানরটি আনন্দ করা দূরের কথা, শসা নেওয়ার প্রতিই সে আর কোনো আগ্রহ দেখায় না। বরং সে আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয় বানরটির দিকে চেয়ে থাকে। যখন সে দেখে দ্বিতীয় বানরটি এবারও লাল আঙুর পেয়েছে। তখন সে রেগে গিয়ে শসাটি সেল রক্ষীর দিকে ছুড়ে ফেলে এবং কোনো পুরস্কারের জন্য আর অপেক্ষা করে না। প্রথমে শসা নিয়ে সে খুশি ছিল। কিন্তু যখন দেখে অন্য বানরটি একই পরিশ্রম করেও বড় পুরস্কার পায়, তখন তার মনে ঘৃণা জন্মাতে থাকে। সেলের সিক ধরে তার উন্মত্তা প্রকাশ করে। এই উন্মত্তার কারণ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। এই পরীক্ষা প্রমাণ করে ন্যায়বিচার পাওয়া যে কারো জন্মগত অধিকার। কোনো অর্জন কিংবা অতিরিক্ত কোনো দাবি নয়। ন্যায়বিচার হলো সামাজিক সন্তুষ্টি এবং সুশৃঙ্খলার মূল ভিত্তি।' শিক্ষকদের চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্যান্যরা যখন দশম গ্রেডের কর্মকর্তার পদমর্যাদার অধিকারী তখন শিক্ষকরা প্রমোশনবিহীন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। এই অসম্মানের জীবন কেন মেনে নেবেন শিক্ষকরা? এটা কি ন্যায়? অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় দৃষ্টি দান করেন প্রাথমিকের শিক্ষক। এ জাতির কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করা উচিত শিক্ষা গুরুদের। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের ললাটে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর কলঙ্ক। দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজন রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর, স্কুল বন্ধ করে দেয়া। শিক্ষকদের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হলো শিক্ষকরা তাদের স্বার্থের জন্য শিশুদের জিম্মি করে না। গুরু দ্রোনাচার্য তার অসম্মানের প্রতিশোধের জন্য অর্জুনকে বেছে নিয়েছিলেন। নিজের ছেলেকে নয়। শিক্ষকরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন একজন অর্জুনের জন্য কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের ভাগ্যে জুটেছে দুর্যোধন। তবে এটাও ঠিক এই প্রথম কেউ একজন বললেন, দশম গ্রেড দেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু দশম গ্রেড চাওয়ার যুক্তি আছে। এই যে যুক্তি আছে কথাটা বলে যেটুকু সম্মান আর সহানুভূতি প্রকাশ করলেন শিক্ষা উপদেষ্টা তারই আলোকে আমরা আশার আলো দেখতে চাই। আদর্শিক রাজনীতি বলতে আমরা বাম দলকে বুঝি। শিক্ষা উপদেষ্টার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে চার লাখ শিক্ষক আশায় বুক বেঁধেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের শিক্ষকদের ললাট লিখনের পরিবর্তন হবে সে প্রত্যাশাই রেখেছে শিক্ষকরা। একটি সভ্য, আদর্শ জাতি গঠনের জন্য সাহসী, সত্যবাদী, মেরুদন্ড সম্পন্ন মেধাবী শিক্ষক প্রয়োজন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী দিয়ে প্রথম শ্রেণির নাগরিক তৈরির স্বপ্ন দেখা বোকামি। আশা করি, শিক্ষকদের বঞ্চনার ইতিহাস পর্যালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘ ৫৩ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে এ রাষ্ট্র ভূমিকা রাখবে। শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক