রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার সময়ের দাবি

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংসদীয় শাসন পদ্ধতি কখনো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়নি। শাসনের নামে কায়েম হয়েছে অপশাসন। গণতন্ত্রের নামে বারবার দেওয়া হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন-স্বৈরতন্ত্রের গাঁথুনি। সেইসঙ্গে তৈরি হয়েছে বৈষম্যের চর্চা। গণতন্ত্র থেকেছে কেবল কথার কথায়।

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন
চারদিকে এখন আলাপ কেবল সংস্কার নিয়ে। সংস্কারের বাংলা অর্থ মেরামত, শুধরানো। আরেক অর্থ ভালো করা বা ভালো হয়ে যাওয়া। বাংলা প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, ভালো হতে পয়সা লাগে না। তাহলে কি লাগে? লাগে সদিচ্ছা। সদিচ্ছা থাকলেই হয়ে যায়। না, কখনো কখনো সদিচ্ছা থাকলেও ভালো হওয়া যায় না। সময় ফুরিয়ে গেলে সদিচ্ছার সঙ্গে থাকলেও ভালো হওয়ার আর সুযোগ থাকে না। বহু বছর পর সেই সময় ও সুযোগটা হাতের নাগালে। গত কয়েকদিন যা ঘটেছে, তা ধারণা করাও কঠিন কারো কারো জন্য। কী থেকে কী হয়ে গেল! কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি শুরুতে ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ও শান্তিপূর্ণ। তাদের দাবিগুলো ছিল একদিকে যৌক্তিক, আরেকদিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে। তারা ক্ষমতার প্রার্থী ছিল না। সরকারের বিদায়ও চায়নি। তারা চেয়েছিল শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার। কোটার বিলুপ্তি নয়। সরকারের পক্ষে ওই দাবি মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সরকার তা কেবল অগ্রাহ্যই করেনি। মারমুখী হয়ে হত্যা-দমন-পীড়নে ছাত্রদের প্রতিপক্ষ করে দিয়েছে। আর গোটা সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণ-আন্দোলন ও গণবিক্ষোভ অনেক হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো বলপ্রয়োগ ও মৃতু্য আগে কখনো ঘটেনি। এর বিপরীতে এবার আন্দোলন সফল হয়নি, পুলিশ-সিভিল-আইনসহ প্রশাসনের দলবাজিসহ করুণ দুর্গতিও ধরা পড়েছে। তা লুকানো, আড়াল করা বা কোনো দোহাই দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং সুযোগ আছে শুধরানোর বা ভালো হয়ে যাওয়ার। সেই উসিলা বা মাধ্যমটা আমাদের সামনে একজন নোবেল জয়ী ড. ইউনূস। ছাত্ররা নিরপেক্ষ লোক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছে। তার সামনে এখন অনেক দায়িত্ব। নানান সংস্কারের দায়িত্ব তার কাঁধে। ১৫ বছর ৭ মাসের তুলনায় ৩০-৩১ দিন কোনো সময়ই নয়। কিন্তু মানুষের চাহিদা-আকাঙ্ক্ষা অপূরণ। দাবিও বিস্তর। বন্যা-দুর্যোগসহ আরও নানান দুর্গতির মাঝেও দাবিতে কোনো ছাড় নেই। নগদে সবার সব দাবি এখনই পূরণ করতে হবে। মানতে হবে। নইলে আদায় করে ছাড়া হবে। এ অবস্থা কারা করেছে, তা সবারই জানা। অবস্থাটা এমন খুন-খারাপি, চুরি-পাচার করে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পারিষদ, এখন সে সবের দায় শোধের ভার প্রদান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তার সরকারের। সেই দায়িত্ব তিনি পালন করে চলেছেনও। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে করতে হচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থাও। গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করতে হয়েছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সইও করেছে বাংলাদেশ। হবে-হচ্ছে করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে টাইপের কথা টানা ১৫ বছর শুনতে শুনতে মানুষের বমি করার দশা হয়েছে। কিন্তু পেটের বমি মুখে আনার সুযোগও ছিল না। সেই অতীষ্ঠ মানুষ এখন নগদে কাজ দেখতে চায়। রাষ্ট্র মেরামতসহ নানা দাবি ও মানুষের উচ্চমাত্রার প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জিততেই হবে সরকারকে। ষড়যন্ত্র, প্রতিবিপস্নবের অপচেষ্টা বা সময়কে দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের পথচলার মধ্যে সেই তেজ স্পষ্ট। হাল ছাড়া বা নেতিয়ে পড়ার নমুনা নেই। মাত্র এক মাস সময়ে সরকারের উলেস্নখযোগ্য কিছু কাজ মানুষকে কেবল আশাবাদী করেনি অবাকও করেছে। আর্থিক খাতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ যে কারো জন্যই বোধগম্য। বিচারিক কু্য, আনসার বিদ্রোহের মতো অঘটন প্রতিহতের পাশাপাশি প্রশাসনে সংস্কার চলছে পুরোদমে। আর সংস্কার স্থায়ী করতে চাই শাসন পদ্ধতি। এই পদ্ধতির ত্রম্নটির কারণে জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে শাসনের নামে অপশাসনের দৈত্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংসদীয় শাসন পদ্ধতি কখনো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়নি। শাসনের নামে কায়েম হয়েছে অপশাসন। গণতন্ত্রের নামে বারবার দেওয়া হয়েছে দুবৃত্তায়ন-স্বৈরতন্ত্রের গাঁথুনি। সেইসঙ্গে তৈরি হয়েছে বৈষম্যের চর্চা। গণতন্ত্র থেকেছে কেবল কথার কথায়। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই পাকিস্তান ভাঙা হয়েছে। বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। বাস্তবে দেশ স্বাধীনের পর গণতন্ত্রের টুটি চেপে সর্বময় ক্ষমতায় দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়েছে। এর মাঝে আর রাখঢাকও রাখা হয়নি। শিনা টান করে বীরবিক্রমে একদলীয়-একনায়কীয় বাকশালই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরপর ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। দফায় দফায় শাসক বদলেছে। কিন্তু একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদ ঠিকই চলেছে। নতুন প্রজন্ম তা ঠিকই মালুম করেছে। রোগটা ধরেছে। যার প্রমাণ বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট দাবি ছিল, আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমন কি সেনাবাহিনী দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার না করা। তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এখন রোগদৃষ্টে ওষুধ দেওয়ার দায়িত্ব ড. ইউনূস সরকারের। অপ্রিয় হলেও সত্য, মুসলিম সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা দুর্বল। তার ওপর কপটতা, ষড়যন্ত্র, হত্যার রাজনীতিতে যুক্ত হতে অভ্যস্থ। অন্য জাতির চেয়ে তাদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজ বিরোধিতা ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব যখন তুঙ্গে, তখনো বড় বড় মুসলিম লীগ নেতাদের কেউ কেউ এর বিপরীতে কাজ করেছেন। ব্যক্তি স্বার্থে কংগ্রেসের প্ররোচনায় মেতেছেন। অখন্ড ভারত চেয়েছেন। জিন্নাহ এতে বিরক্ত হয়ে রাজনীতি ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হয়ে যান। কবি আলস্নামা ইকবাল মুসলিমদের দুরবস্থা বুঝতে পেরে ছুটে যান লন্ডনে বুঝিয়ে শুনিয়ে জিন্নাহকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। গোটা ভারতে তখন মুসলিম জনগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশই পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে। এর ফাঁকেও বহু মুসলিম নেতা এর বিরোধিতায় লিপ্ত হন। জামায়াতে ইসলামীও পাকিস্তান সৃষ্টির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ব্রিটিশ সরকার এতে দোটানায় পড়ে যায়। তবে তারা জানত ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে। তখন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা প্রচুর। শিখ সৈন্যও ছিল হিন্দুদের চেয়ে বেশি। শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, মনোহর গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, বলস্নব ভাই প্যাটেলসহ কতক নেতার ষড়যন্ত্র দেখে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দেন। এতে কলকাতা, বিহার ও পাঞ্জাবে রায়ট বাঁধে। ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীতে অসহযোগ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার অ্যাটনি অ্যালিওয়েল দিলিস্নর ভাইসরয়কে যত দ্রম্নত সম্ভব ভারত ছাড়ার হুকুম দেন। প্রসঙ্গক্রমেই আসছে সেই ইতিহাস। ওইসব ঘটনা ও বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনায় স্পষ্ট শান্তিকামী জনগণের আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতিতে। তা দুই কক্ষের হলে পদ্ধতিটি বরং আরও টেকসই হবে। তা করতে নির্বাচন বা সংসদের ওপর ভরসা করা লাগে না। বরং এমন ভরসা করলে জটিলতা আরও পাকবে। উদ্যোগ ভন্ডুলও হতে পারে। সেই অপেক্ষা না করে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমেই তা এখনই করা যায়। ড. ইউনূসের বিপস্নবী সরকার এই বিপস্নবী কাজটি করলে বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে। সব চেয়ে বড় কথা স্বৈরশাসন-কর্তৃত্ববাদের রাস্তা বন্ধ হবে। দেশীয় জনপ্রিয়তার সমান্তরালে ড. ইউনূস উচ্চমার্গের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে তার ধারে কাছে কেউ নেই। বিগত ২০-২২ বছরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তার বিস্ময়কর কীর্তি। শাসন পদ্ধতির একটি কীর্তি তিনি গড়লে তা দেশ-বিদেশে সমাদৃত হবে। ইতিহাসে কেবল সংস্কারক নন, ত্রাতা হিসেবেও লেখা থাকবে তার নাম। গত এক মাসেই তার নানান সংস্কার কাজের কোনো কোনোটি বিস্ময়কর। সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দাখিল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কারের নির্দেশনার কাজ হচ্ছে ম্যাজিকের গতিতে। এরই মধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাধ্যমিকে আবারও ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। উচ্চশিক্ষা স্তরের স্থবিরতা কাটাতে ঢাকাসহ বেশ ক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বদল করা হয়েছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান বদলও করা হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনের স্থবিরতাও সরকারের চোখ এড়ায়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। আরও কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনেও সংস্কারের ছোঁয়া পড়েছে। মাত্র এক মাসে এত কাজ কল্পনা শক্তিকে হার মানানোর মতো। অবশ্যই আরও অনেক কাজ এখনো বাকির খাতায়। সংসদীয় পদ্ধতির কোনো সরকার চাইলেও এ কাজগুলো এক মাস কেন, কয়েক যুগেও পারত না। ড. ইউনূস তা এক মাসে এক হাতে পেরেছেন তার পারিষদকে একাট্টা করে। সংসদীয় পদ্ধতিতে অন্তত বাংলাদেশে তা কখনো সম্ভব হতো না। শাসনতান্ত্রিক এ পদ্ধতিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সময়টা এখনই। \হ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন : লেখক ও গবেষক