দেশদ্রোহিতা : অপরাধের ধরন ও শাস্তির বিধান
আমরা যদি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করি, দেশকে ভালোবাসি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করি তাহলে শিগগিরই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে ইনশাআলস্নাহ।
প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৭
মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা প্রতিটি মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি শব্দ পরস্পর পরিপূরক। একটিকে বাদ দিলে অন্য দুটি তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সম্প্র্রতি দেশের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অধিকাংশ মানুষ চেষ্টা করছে। তবে, কিছু গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, যা দেশদ্রোহিতার শামিল। দেশপ্রেম (Patriotism) হলো মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং দেশের কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা। এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা- যা ব্যক্তি তার দেশের সার্বভৌম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহিত করে। দেশপ্রেমিক ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে। যা আমরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আমাদের দেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং শেষ ২৪-এর শিক্ষার্থী-জনতার গণ-অভু্যত্থানে সিংহভাগ মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও অনেক মানুষ তাদের নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে এটিই দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া, আরও অনেকে বিভিন্নভাবে ইতিবাচক কাজকর্ম করার মাধ্যমে দেশের সম্মান বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াও দেশপ্রেম। দেশদ্রোহিতা বা ঞৎবধংড়হ হলো দেশের স্বার্থের বিরোধিতা করা, দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন ও দেশের গোপন তথ্য অন্য দেশকে প্রদান করা এবং অন্য দেশের বা কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় দেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই হচ্ছে দেশদ্রোহিতা। বাংলাদেশের আইনের দেশদ্রোহিতার সংজ্ঞা (দন্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী) সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা অসন্তোষ সৃষ্টি, সরকারের কর্তৃত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা ও উসকানিমূলক লেখা, বক্তব্য বা প্রচারণা করাকেই দেশদ্রোহিতা বলে। বাংলাদেশের আইনের আলোকে দেশদ্রোহিতার অপরাধের ধরন : ১. বিদেশি শক্তির সহযোগিতায় দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ। ২. দেশের সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তা বিপন্ন করার চেষ্টায় অংশগ্রহণ। ৩. রাষ্ট্রবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা সহায়তা করা। ৪. উসকানিমূলক বক্তব্য বা প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে বিদ্রোহে প্ররোচিত করা। ৫. সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র। এই সমস্যা কার্যক্রম করলেই তা দেশদ্রোহী অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে। দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা : আরা-১২১: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা ষড়যন্ত্র। আরা-১২১(ক): দেশদ্রোহিতার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র। আরা-১২৪(ক): রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য, লেখা বা কাজ। দেশদ্রোহিতার শাস্তির বিধান : আরা-১২১ অনুযায়ী মৃতু্যদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। ধারা-১২৪(ক) অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ড সর্বনিম্ন ৩ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড বিচার প্রক্রিয়ার নিয়ম ১. অভিযোগ গঠন: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযোগ তদন্ত করে প্রমাণাদি সংগ্রহ করে। ২. বিশেষ আদালত : দেশদ্রোহিতার বিচার সাধারণত বিশেষ ট্রাইবু্যনালে হয়। ৩. প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা: অপরাধ প্রমাণে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া, দেশদ্রোহিতার মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালেও করা যেতে পারে। নিচে চারটি প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো : ইসলাম ধর্ম : পবিত্র কোরআন ও হাদিস কোরআনে সরাসরি 'দেশপ্রেম' শব্দটি উলেস্নখ করা হয়নি। তবে দেশকে রক্ষা করা, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। দেশপ্রেম সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত : ১. সূরা আল-বাকারা (২:১২৬): হে আমার প্রভু, এই নগরকে শান্তিময় কর এবং এর অধিবাসীদের ফল-ফলাদি দ্বারা রিজিক দাও। \হএটি দেশ ও মানুষের কল্যাণ কামনার উদাহরণ। ২. সূরা আন-নিসা (৪:৭৫): তোমরা আলস্নাহর পথে এবং নিপীড়িত পুরুষ, নারী ও শিশুদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছ না কেন? এখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং শান্তির জন্য লড়াই করার কথা বলা হয়েছে। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয় বা দেশদ্রোহিতার বিষয়ে : ১. সূরা আল-মায়েদা (৫:৩৩): যারা আলস্নাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে দুষ্কর্ম ছড়ায়, তাদের শাস্তি হলো হত্যা, শূলীতে চড়ানো, হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া বা নির্বাসিত করা। হাদিসের আলোকে : ১. হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : তুমি যদি তোমার জন্মভূমি বা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা পোষণ না কর, তবে তোমার ইমান পূর্ণ হবে না। ২. নবীজী হিজরতের সময় মক্কা ত্যাগ করার আগে বলেছিলেন : তুমি আমার প্রিয় শহর, যদি তোমার লোকরা আমাকে বের করে না দিত, তবে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। হিন্দু ধর্ম : পবিত্র বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থ অনুসারে : হিন্দু ধর্মের পবিত্র বেদ ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব পালনের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দেশপ্রেম সম্পর্কিত গ্রন্থের উদ্ধৃতি : ১. ঋগ্বেদ (১০.১৮.১০): পৃথিবী আমার মাতা, আর আমি তার পুত্র। ২. মনুস্মৃতি : দেশের রক্ষার জন্য কাজ করা ধর্মীয় দায়িত্ব। ৩. ভগবদ গীতা : কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মত্যাগ ও কর্তব্য পালনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। দেশদ্রোহিতার বিষয়ে : ১. ঋগ্বেদ (৬.৭৫.১৯): তোমরা সেই শত্রম্নদের দমন কর, যারা সমাজ ও ধর্মের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ২. মনুস্মৃতি (৭:৯৬-৯৮): যে ব্যক্তি দেশের ক্ষতি করে, তাকে কঠোরভাবে দমন করা উচিত। বৌদ্ধ ধর্ম : পবিত্র ত্রিপিটক বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিপিটকে সরাসরি দেশপ্রেম শব্দটির উলেস্নখ নেই। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের নিন্দা করার নির্দেশ রয়েছে। দেশপ্রেম সম্পর্কিত প্রসঙ্গ : ১. অঙ্গুত্তর নিকায় (AN ৪.২৫৬): সৎ রাজাকে দেশের জনগণের মঙ্গল ও শান্তি রক্ষায় কাজ করতে হবে। ২. কাককাশন্ড সূত্র : দেশের শান্তি রক্ষায় নীতিবান জীবনযাপন গুরুত্বপূর্ণ দেশদ্রোহিতার বিষয়ে : ১. মহাপরিনির্বাণ সূত্র : ২. যারা অন্যায় কাজ করে, তাদের 'অধর্মচারী' বলা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। খ্রিষ্টান ধর্ম : বাইবেল বাইবেল সরাসরি দেশপ্রেমের কথা উলেস্নখ না করলেও দেশ, শাসক এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। দেশপ্রেম সম্পর্কিত বাইবেলের উদ্ধৃতি : ১. যেরেমিয়াহ (২৯:৭): তোমরা যে শহরে নির্বাসিত হয়েছ, সেই শহরের মঙ্গল কামনা কর এবং তার জন্য প্রার্থনা কর। দেশদ্রোহিতার বিষয়ে : ১. হিতোপদেশ (২৪:২১) : প্রভু ও রাজাকে ভয় কর এবং যারা বিদ্রোহী তাদের সঙ্গে যোগ দিও না। উপরোক্ত ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে দেশপ্রেমের গুরুত্ব এবং ষড়যন্ত্রকারীদের নিন্দার বিষয়টি স্পষ্ট। এছাড়া, বাংলাদেশের আইনের আলোকে দেশদ্রোহী অপরাধের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। আসুন, আমরা যার যার ধর্মীয় অনুশাসন, বিধিবিধান এবং দেশের আইন পালন করি দেশকে ভালোবাসি। দেশের শাসককে তাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করি। আমরা যদি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করি, দেশকে ভালোবাসি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করি তাহলে শিগগিরই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে ইনশাআলস্নাহ। সাইদুর রহমান সাঈদ : নবীন লেখক