বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি

আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনূস সরকারের জন্য নিজেদের কর্মের মূল্যায়ন ও নতুন ভাবনা যুক্ত করাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক করার পথে এই সরকার যদি রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মতিসহ শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, জনগণ আস্থা হারাবে না।
রেজাউল করিম খোকন
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি

আমরা এখন যখন ঢাকা এবং অন্যান্য শহরের রাস্তায় হাঁটি, তখন রাস্তাগুলোর দেয়ালে তরুণদের আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আঁকা রঙিন চিত্রকর্মগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। এই চিত্রকর্মগুলো দেখলে যে কেউ তরুণদের সৃজনশীলতার শক্তিতে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। এখানে কোনো ডিজাইনার ছিল না, কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছিল না এবং কেউ এর জন্য তহবিল দেয়নি। দেশের লাখ লাখ মানুষ আজ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ। আমরা মাত্র চার মাস আগে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছিলাম। বাংলাদেশ বারবার দেখিয়েছে কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। জুলাই-আগস্টের গণ-অভু্যত্থানে তরুণ সমাজ ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে গত ১৬ বছর ধরে শাসন করা এক ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। স্বৈরাচারের বাংলাদেশি আইকন দেশ ছেড়েছেন সেই গত ৫ আগস্ট গণঅভু্যত্থানের উত্তাল দুপুরে। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এ জন্য এক হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী, শ্রমিক এবং সাধারণ প্রতিবাদকারীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার ছাত্র-জনতা। আমরা তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি, যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন- যারা চিরদিনের জন্য তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দৃষ্টিশক্তি এবং শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন এবং যারা এখনো জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। অন্তর্র্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে, অনিয়মে ভরা বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এটা করা হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর চেয়েও বেশি কিছু। সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিটির মধ্যে পাঁচটিরই কাজ হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ক। বাংলাদেশে নির্বাচনের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে ভবিষ্যতে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে তার বিস্তৃত রাজনৈতিক সংস্কারের নীতি সফলভাবে এগিয়ে নিতে হবে। কাজেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে- যাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আছে। সেই সঙ্গে তারা সবাই নির্দলীয় ব্যক্তি। একযোগে পদত্যাগের পর নির্বাচন কমিশন ছেড়ে যাওয়া কমিশনাররা বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা। গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে আশাবাদী সবাই। একই সঙ্গে নির্বাচনী সংস্কার কমিশন সংস্থাটির ক্ষমতা ও দায়িত্বে পরিবর্তনের প্রস্তাব করবে। অন্তর্র্বর্তী সরকার ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করবে বলেও জানিয়েছে। একটি মূল বিষয় হলো এখনকার নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে কিনা। সমালোচকদের মতে, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিষাক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এর বিপরীতে তাদের যুক্তি, সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করা গেলে আরও বেশি রাজনৈতিক দলের জন্য জায়গা তৈরি হবে। আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা দরকার- যা জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য সময়মতো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা কীভাবে বিন্যাস করা যেতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টায় সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখন পর্যন্ত দেওয়া মৌখিক সমর্থন আশাব্যঞ্জক। যেমন, কয়েকশ' কোটি ডলার ঋণসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে- যা বাড়ানো উচিত। ড. ইউনূসের উচিত সরকার এবং এর সংস্কার পরিকল্পনায় আরও সমর্থন আদায়ে তার ব্যক্তিগত পরিচিতি কাজে লাগানো। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ইউনূস সরকারকে বাস্তব সহযোগিতা দেওয়া। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ সরকারের জন্য বড় হুমকি। শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতকে যে জগাখিচুড়ি অবস্থায় রেখে গেছে, তা ঠিকঠাক করতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা এসব প্রতিষ্ঠান দিতে পারে। প্রতিশ্রম্নত কয়েকশ' কোটি ডলারের অতিরিক্ত সহায়তা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার প্রতি দীর্ঘস্থায়ী সমর্থন এবং তার শাসনামলে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের চেয়েও নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া নিয়ে তৈরি ব্যাপক ধারণা বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর কিছু সদস্যদেশ ব্যবসার প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী ছিল বলে মনে করা হয়। এখন তাদের সেই ক্ষতি মেরামত করার সুযোগ এসেছে। ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকারের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার আনার অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক ঝুটঝামেলাও আছে। সংস্কার কর্মসূচির দিকে নজর দিতে চাইলে ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। বিভক্তির জায়গাগুলোয়ও নজর দিতে হবে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূস নিয়মিত বৈঠক করছেন। দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে বৈঠক হচ্ছে, আবার আলাদাও বৈঠক হচ্ছে। ওইসব দলের নেতাদের মতামত জানতে চাওয়া হচ্ছে এবং ড. ইউনূসও তাদের তার পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছেন। যদি রাজনৈতিক পক্ষগুলো সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তবে এ মুহূর্তে সবকিছুই সম্ভব। অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। তারা সংস্কারের জন্য ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীদের সময় দিতে চায়। দলীয় নেতাদের প্রতিশোধমূলক সহিংসতা থেকে বিরত রাখতে এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত সদস্যদের বহিষ্কারের মতো প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন বিএনপির নেতারা। দলটি সংস্কার কমিশনের কাছেও সুপারিশ করেছে। তবে ড. ইউনূসকে বিএনপি কতটা সময় দিতে চায়, তা স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকদের সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচার চালাতে আগ্রহী। সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি অন্তর্র্বর্তী সরকারকে নজরদারিতে রাখার কাজ করছে। তবে তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের কথা মাথায় রেখে দলটি ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ, দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ইতোমধ্যে তরুণ প্রজন্মের মোহ ভেঙে যাচ্ছে। পাছে তারা বিএনপি থেকেও মুখ ঘুরিয়ে না নেয়, সে কথা মাথায় রেখেছে দলটি। বিএনপিকে ঠেকাতে পারে অন্তর্র্বর্তী সরকারের দুই প্রধান সমর্থক- শিক্ষার্থী ও সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তিনি তার ক্ষমতা দেখান না, তবে কোনো না কোনোভাবে তিনিই এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছেন। জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভের পর বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রদের উত্থান হয়। যদিও ছাত্ররা এখনো কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। তাদের আগ্রহের জায়গা অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ঘিরেই। এ ক্ষেত্রে তারা চায় অন্তর্র্বর্তী সরকার বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকুক এবং বড় ধরনের সংস্কার আনুক। তাই বলে ছাত্রদের এক পাশে সরিয়ে রাখাটা যে সহজ কাজ হবে, তা কিন্তু নয়। সাংবিধানিক সংস্কার, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ এবং নৃশংসতার ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সদস্য এবং ছাত্র নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমাগত সামনে আসছে। ছাত্র নেতারাও রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান বলে মনে করা হয়। যদিও রাজনৈতিক দল গঠন করতে সময় লাগবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এতটাই নোংরা যে শিক্ষার্থীরা এখন খেলায় নামলে তারাও অন্য দলগুলোর মতো হয়ে যাবেন। ফলপ্রসূ সংস্কারের পর শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। আর এটা আগামী নির্বাচনের পর হতে পারে। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি পস্ন্যাটফর্ম করেছে। এ পস্ন্যাটফর্মটি সংস্কারের পক্ষে তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন তৈরি করতে চায়। সংস্কারের দাবি ছাড়া শিক্ষার্থীরা কোনো মতাদর্শিক জায়গা থেকে সংঘবদ্ধ নয়। গণ-অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। যদি জনসমর্থন ধরে রাখতে না পারে, তাহলে এই সরকারকে হয়ত একটি আগাম নির্বাচন দিতে হবে। আর এটা হলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে বিএনপি। তবে, ক্ষমতায় গেলে দলটিকে হতে হবে সংযত।

রাষ্ট্র সংস্কারের বিরল যে সুযোগ এসেছে, তা-ও হাতছাড়া হতে দেয়া যায় না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, যদি বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অরাজকতায় রূপ নেয়। এ ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী হয়তো ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসতে পারে। এতে দেশে আবার সামরিক শাসন শুরু হতে পারে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষের উচিত, এ রকম কিছু একটা যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সজাগ থাকা। দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে। এ জন্য ধীরগতিতে হলেও সরকার যে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পেরেছে, তা দেখাতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসার মতো বিষয়গুলোয় এই সরকার অবশ্য ইতোমধ্যে কিছু সাফল্য দেখিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা পদে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজ বিশ্বকে মুগ্ধ করে, সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই রাজনৈতিক সমর্থন অন্তর্র্বর্তী সরকারের জন্য বেশ গুরুত্ববহ। আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর উচিত, অন্তর্র্বর্তী সরকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন দিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করা এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন যুগে নিয়ে যেতে সহায়তা করা। শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত সামনে আসছে। এরপরও বর্তমানে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাই অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায়। আসছে বছরগুলোয় এই আকাঙ্ক্ষা কীভাবে ধরে রাখা যায়, সেটা চিহ্নিত করতে হবে ইউনূস সরকারকে। পাশাপাশি সংস্কার কাজে ধীরে ধীরে গতি আনতে হবে। একটি নির্বাচন আয়োজনের পথও তৈরি করতে হবে।মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অন্তর্র্বর্তী সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। এর মধ্যে একটি হতে পারে রাষ্ট্রীয় সেবাদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে গেঁড়ে বসা দুর্নীতি মোকাবিলা। সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরবে। এখনো পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি সমাজে। রাষ্ট্রীয় জীবনের আত্মবিশ্বাসও ফেরেনি। তা না হলে দৃশ্যত দিলিস্ন থেকে ফ্যাসিবাদী 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র 'ফাঁস' করা টেলিফোন কথোপকথনের হুমকিতে সারাদেশ কাঁপে কী করে? প্রশাসন তটস্থ, জনগণ অস্থির হয়ে পড়ে কেন? দেশের মানুষ আওয়ামী আমলের গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে কতটা মুক্তি পেল এবং অতঃপর তারা বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক সুযোগ পাওয়ার সুযোগ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছে কিনা, সে মূল্যায়নের সময় কিন্তু এসে গেছে। প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে যা চলছিল, তা স্থিতিশীলতা নয়, ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতিতে গড়া অপশাসনের শৃঙ্খল। ওই ব্যবস্থার প্রতি নূ্যনতম গণ-আস্থা থাকলে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে তা খান খান হয়ে যেত না। তারপরও এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনার 'স্মৃতি কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে'। হাসিনা এখন অতীত। তার শাসনামলে হারিয়ে যাওয়া গণমানুষের আস্থা ও আশাবাদ ফেরানোর প্রতিশ্রম্নতি নিয়েই ক্ষমতার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রক্ত ঝরার বেদনা বিপস্নবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এই অভাবনীয় ঘটনার ফলে জনমনের প্রাথমিক স্বস্তি ইউনূস সরকারের জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান, কৃতিত্ব নয়। একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। ইউনূস সরকারের উদ্যোগগুলো, বিশেষ করে সংস্কার কার্যক্রমকে, টেকসই বা কালজয়ী করতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতিশ্রম্নতি ও অংশীদারত্ব অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে, কমিউনিকেশন গ্যাপ বা কিছুটা অনিশ্চয়তা মানুষকে আশাহত করে। প্রফেসর ইউনূসের সরকার, তার উপদেষ্টাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যে শুধু অন্তর্র্বর্তী প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজ করবেন তা নয়; তারা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করবেন, এমনটাই কাঙ্ক্ষিত। শেখ হাসিনার পরাজিত ও ক্রুদ্ধ সমর্থকরা প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচারী বা সংবিধানবহির্ভূত শাসক আখ্যা দিলে তাতে তার ও বাংলাদেশের মানুষের অবাক ও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তার সরকার রাজনৈতিক অনাস্থার মুখে যদি প্রস্থানের পথ খোঁজে, তাহলে তা জাতির জন্য অমঙ্গলেরই হবে। ফ্যাসিবাদের বিষবৃক্ষ ও তার ডালপালা গজানোর ভবিষ্যৎ সুযোগ থাকাটা মোটেও কাম্য নয়।

আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনূস সরকারের জন্য নিজেদের কর্মের মূল্যায়ন ও নতুন ভাবনা যুক্ত করাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক করার পথে এই সরকার যদি রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মতিসহ শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, জনগণ আস্থা হারাবে না।

ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য চাই।

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে