বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহু-সাংস্কৃতিক দেশ। যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করে। সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ- যা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে।
বাংলাদেশের সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি শুধু সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্যই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি সমাজে সব ধর্ম ও সম্প্র্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাস করতে পারে, তখন সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারে এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে- যা সমাজকে আরও বৈচিত্র্যময় ও সৃজনশীল করে তোলে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির চিত্র বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গ্রামের মানুষ সাধারণত একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়। তারা বিভিন্ন সামাজিক কাজে একত্রিত হয় এবং পরস্পরের পাশে দাঁড়ায়। এই সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রামের মানুষের জীবনে একটি বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং তাদের সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, কবি নজরুলের কবিতা কিংবা লালন ফকিরের দোহা- সবকিছুতেই সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির ছোঁয়া রয়েছে। এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন শুধু শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সাধারণ মানুষের মাঝেও একটি গভীর সংযোগ তৈরি করে। তবে সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি বজায় রাখতে হলে শুধু সরকার ও নাগরিকদের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, গণমাধ্যমের ভূমিকা এখানে অপরিহার্য। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা এবং সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির বার্তা প্রচার করা। যখনই কোনো সাম্প্র্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়, তখন গণমাধ্যমের ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সমাজকে শান্ত ও স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতিশ্রম্নতি দেয়। এখানে হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। তবে, কখনো কখনো কিছু স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী এই সম্প্র্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা বা হানাহানির সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সব সময় এই ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং সম্প্র্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে। বাংলাদেশ সরকারও সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও সমান গুরুত্ব দেয়- যা সব ধর্মের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করে। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেও সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হচ্ছে। এর ফলে, শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির গুরুত্ব বুঝতে পারছে এবং ভবিষ্যতে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে। সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকেরও কর্তব্য। প্রত্যেককে নিজের অবস্থান থেকে সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য কাজ করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই সম্প্রীতির চর্চা ও প্রসার ঘটাতে হবে। সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া- যা ক্রমাগত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা দিয়ে বজায় রাখতে হয়। আমাদের প্রতিদিনের আচরণ ও চিন্তাধারায় এই সম্প্রীতির মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। তবেই আমরা একটি সত্যিকার অর্থে মানবিক ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষ সমানভাবে সম্মানিত ও নিরাপদ থাকবে।
মোহাম্মদ আব্দুর রহমান : কলাম লেখক