সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণঘাতী সংকট

দুর্ঘটনা বা যে কোনো ক্ষয়ক্ষতির কারণ যাই হোক না কেন, এমন দুর্ঘটনা যাতে আর ভবিষ্যতে না ঘটে তার জন্য টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি।

প্রকাশ | ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সেতু খানম
মানবজীবনের অস্বাভাবিক মৃতু্যর অপর নাম সড়ক দুর্ঘটনা। এটি এমন একটি আকস্মিক বিপর্যয়- যা পরিপূর্ণভাবে সুস্থ সবল একটি মানব শরীরকে নিমিষেই নিথর দেহে পরিণত করে। সড়ক দুর্ঘটনা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি- যা রাস্তায় বা মহাসড়কে ঘটে থাকে। একটি যানবাহনের সঙ্গে অপর যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, যানবাহন কর্তৃক পথচারীকে চাপা দেওয়া, রাস্তার পাশের অন্য যে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগা, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যাওয়া কিংবা খাদে পড়ে যাওয়ার ফলে প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষতি হলে সাধারণভাবে তাকে সড়ক দুর্ঘটনা বলা হয়। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশেও সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত যে কোনো দেশের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা একটি মারাত্মক অভিশাপ স্বরূপ। এটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের গতি মন্থর করে। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুললেই এটি সাধারণ একটি শিরোনাম হয়ে ধরা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা ১৩ লাখ প্রাণহানি ঘটে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২২টি এবং প্রতি বছর গড়ে ৭৫০০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সমস্ত তথ্য পর্যালোচনায় বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন এবং প্রতি বছর গড়ে ২৪ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। প্রতি বছর আহত হয় প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ এবং প্রতিবন্ধী হয় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬০ হাজার ৯৮০টি। এতে নিহত হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৩৮ জন এবং আহত হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জন। বিভাগ অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা, আহত এবং নিহতের সংখ্যা কিছু কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে। রাজধানী ঢাকা শহরে সব থেকে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা প্রাণহানি ঘটে। মোট মৃতু্যর প্রায় ২৫ শতাংশ। এরপরই রয়েছে দেশের একমাত্র দ্বিমাত্রিক শহর চট্টগ্রাম। মোট মৃতু্যর প্রায় ১৮.৫০ শতাংশ ঘটে থাকে অন্যতম বাণিজ্যিক বিভাগ চট্টগ্রামে। এরপরই সড়কে মৃতু্যর মিছিলে ১৪ শতাংশ নিয়ে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। দেশের দক্ষিণ বঙ্গ নামে খ্যাত জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল খুলনা বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১১.৩৪ শতাংশ মানুষ। এছাড়া, রংপুর বিভাগে ৯ শতাংশ, ৮ শতাংশ নিয়ে পাশাপাশি অবস্থায় আছে বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগ। এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃতু্যর ৬ শতাংশ ঘটে থাকে সিলেট বিভাগে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে সড়ক নির্মাণে পরিকল্পনার অভাব বা অবকাঠামোগত ত্রম্নটি, অদক্ষ চালক, ঘুম বা মদ্যপান অবস্থায় যানবাহন চালানো, ওভারটেকিং প্রবণতা, মাত্রাতিরিক্ত গতিবেগে গাড়ি চালানো, যানবাহনে ত্রম্নটি বা অবৈধভাবে ফিটনেসবিহীন যান চালান, পথচারীদের সচেতনতার অভাব, চালকদের শারীরিক ক্লান্তি এবং আবহাওয়াজনিত কিছু কারণ। দুর্ঘটনা বা যে কোনো ক্ষয়ক্ষতির কারণ যাই হোক না কেন, এমন দুর্ঘটনা যাতে আর ভবিষ্যতে না ঘটে তার জন্য টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। যেমন সড়ক নির্মাণে সঠিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ চালক নিয়োগ অথবা প্রয়োজনীয় ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করা, ওভারটেকিং প্রবণতা কমাতে সড়কে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় চেকিংয়ের ব্যবস্থা, অবৈধ ফিটনেসবিহীন যানগুলোকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণের নিয়ম তৈরি এবং তদারকির ব্যবস্থা করা, সঠিক ট্রাফিক সিগনালের ব্যবস্থা, উন্নত দেশগুলোর মতো বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা, বিভিন্ন সভা সেমিনারের মাধ্যমে পথচারীদের সচেতন করা ইত্যাদি। এছাড়া, সড়ক নিরাপত্তা আইন জোরালো করা। সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক সামাজিক এবং জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত সড়কে ঝরছে তাজাপ্রাণ, মায়ের বুক হচ্ছে খালি। চারদিকের 'উন্নয়ন' শব্দের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মতো কালসাপ। সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই হয়ত শেষ করা সম্ভব নয়, তবে অনেকখানি কমানো সম্ভব। তাই সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। তবেই সড়ক দুর্ঘটনার মতো একটি ব্যাধিকে কমানো যাবে। সেতু খানম : কলাম লেখক