প্রয়োজন মানসিক সংস্কার

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

রাকিব হাসান
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতা প্রশংসনীয়। তবে সত্যিকার অর্থে একটি সমাজের উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন এর নাগরিকরা মানসিকভাবে ইতিবাচক, নৈতিক ও উদার মানসিকতার অধিকারী হয়। আমাদের চারপাশের অনেক সমস্যার মূলেই রয়েছে মানসিকতার সীমাবদ্ধতা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সঠিক নৈতিক মূল্যবোধের অভাব। তাই দেশের সার্বিক অগ্রগতির জন্য মানসিক সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। চব্বিশের গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত শব্দ সংস্কার। দেশের সব ক্ষেত্রেই সংস্কার চায় মানুষ। নতুন বাংলাদেশকে তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবাই সাজাতে চাচ্ছে। তবে অবকাঠামোগত, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইত্যাদি বিষয়ে সংস্কার হলেও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসিক সংস্কার। বাংলাদেশের সমাজে পরিবর্তন দ্রম্নতগতিতে হচ্ছে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের পরও আমরা অনেক সামাজিক বাধা, কুসংস্কার এবং সংকীর্ণ মানসিকতায় বন্দি। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানসিক উন্নয়ন ছাড়া শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। মানসিকতা গঠন করে সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা। প্রথমেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, নৈতিক এবং ব্যবহারিক করতে হবে। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারে না। শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শেখাতে হবে, যাতে তারা সহানুভূতিশীল, উদার এবং সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, নৈতিক শিক্ষার প্রচার এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের চর্চা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনো বিভিন্ন কুসংস্কার এবং ভুল ধারণার মধ্যে বসবাস করে। এর ফলে সমাজে বিভেদ, বৈষম্য ও অস্থিরতা বাড়ছে। আমাদের প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যেখানে প্রতিটি নাগরিক বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তা করতে শিখবে। পরিবার একটি মানুষের মানসিক গঠন ও নৈতিকতার প্রথম স্থান। সঠিক পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবেই অনেক সামাজিক সমস্যা বাড়ছে। বাবা-মা ও অভিভাবকদের উচিত, তাদের সন্তানদের প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া, নৈতিক শিক্ষা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করা। প্রথাগত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং পুরনো চিন্তাধারা মানুষকে আধুনিক জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাধা দেয়। বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতির দেশ। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। মানসিক সংস্কারের মাধ্যমে সবার প্রতি সহনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা জাগানো প্রয়োজন। বাংলাদেশে ধর্ম, জাতি, এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে অনেক বিভাজন রয়েছে। মানসিক সংস্কার সমাজে সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। আমাদের ঐক্য ও শান্তির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জুলাইয়ের স্মৃতি ও ঐক্য ধরে রাখতে তাই সবাইকে মানসিকভাবেও প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা অনেক সময় নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকি, কিন্তু দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীন। মানসিক সংস্কারের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, নিয়মানুবর্তিতা এবং আইন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে মানসিক সংস্কার কেবল একটি প্রয়োজন নয়, এটি সময়ের দাবি। যেমন : ট্রাফিক আইন মান্য করা, নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা, অযথা হর্ন না বাজানো ইত্যাদি। সুতরাং, সরকারের গৃহীত সংস্কারগুলো তখনই বাস্তবায়ন হবে যখন সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন সম্ভব হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রায়শই দলীয় স্বার্থ, সংঘাত এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা জাতীয় স্বার্থকে পিছিয়ে দেয়। এই মানসিকতার পরিবর্তন কেবল নেতৃত্বের মধ্যেই নয়, সাধারণ জনগণের মধ্যেও প্রয়োজন। দলীয় সংঘাত কমিয়ে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির বিকাশ ঘটানো ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বাইরে গিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের জন্য নাগরিকদের মানসিকতা ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, যাতে আমরা একটি মানবিক, শান্তিপূর্ণ এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। রাকিব হাসান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা কলেজ।