কোনো একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে, আবহাওয়া আরও চরম হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশি কোনো না কোনোভাবে পরিবর্তনজনিত সমস্যার ভুক্তভোগী। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনে একটি প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিনহাউজ ইফেক্ট। শক্তি উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই গ্যাসগুলো ক্রমাগত বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে চলছে। একইভাবে বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্ট। বিশেষ করে তীব্র তাপদাহ, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙ্গন কিংবা বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার কথা চিন্তা করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হলো বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকারক গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ছাড়াই বিদু্যৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস) ভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর বিপরীতে সোলার পাওয়ার পস্নান্ট, হাইড্রো পাওয়ার পস্নান্ট, বায়ুকলের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লিন এনার্জি উৎপাদন করা সম্ভব। যেখানে বস্তুকণা সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বায়ুদূষক ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গত হবে না।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোট বিদু্যৎ উৎপাদনের ৯১.৩% জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, ১.৩% নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত হয় এবং অবশিষ্ট ৭.৩% বিদু্যৎ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, যার মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদু্যতের পরিমাণ ১.৯%। যার ফলশ্রম্নতিতে দেশের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের সিংহভাগ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বিদু্যৎ উৎপাদনের ফলে নিঃসরিত হয়ে থাকে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় ডিজেলের পরিবর্তে সোলার সেচ পাম্পের মাধ্যমে চাষাবাদ করার প্রক্রিয়াকে আরও উৎসাহিত করা। ডিজেলের পরিবর্তে সোলার সেচ পাম্প ব্যবহার করে চাষাবাদ করার মাধ্যমে এটি শুধু কার্বন নিঃসরণই কম হবে না, একইসঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদ সংরক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে। এছাড়া ক্লিন এনার্জি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর মাধ্যমে এটি আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এত এত সুবিধা থাকার পরও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ নেই। তবে বিগত সময়ে বেশ কয়েকটি ভালো উদ্যোগ দেখা গেলে ও তার যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে এর কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয়নি। যেমন- ২০১০ সালে গ্রিড সংযোগ পাওয়ার শর্ত হিসাবে গৃহস্থালী, শিল্প ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় ছাদে সৌরশক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা বসানো বাধ্যতামূলক হয়েছিল। দেশের মোট উৎপাদিত বিদু্যৎ শক্তিতে নবায়নযোগ্য অংশগ্রহণ বাড়াতেই নেওয়া হয় এ পদক্ষেপ। কিন্তু সৌর প্যানেলগুলোতে নিম্নমানের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা এবং জনসচেতনতার অভাবে কার্যক্রমটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ছাদের সৌর ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশে একটি সন্তোষজনক মাত্রায় নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদু্যৎ পাওয়া সম্ভব। এসব দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বারোপ দেওয়া জরুরি।
এছাড়া আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলমান কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনে যেসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে সেগুলো হলো কার্বন নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, জলবায়ুর ওপর শিল্পের প্রভাব কমাতে পারে এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ প্রভৃতি। বাংলাদেশ এবার জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে কথা বলবে। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলো অর্থায়ন করলে উন্নয়নশীল দেশ সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে যেমন বিনিয়োগ করতে পারবে তেমনি অভিযোজিতও হতে পারবে। এছাড়া ন্যায্য স্থানান্তর, জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা করবে। বাস্তবিক অর্থে বর্তমান পৃথিবীতে বাঁচাতে গেলে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা জলবায়ু বিপর্যয় রোধ করে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারব।
এ বি এম সিয়াম আহমেদ
শিক্ষার্থী
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ