বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এর তথ্যমতে বাংলাদেশে অকার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা ৩৬টি, সেইসঙ্গে এক বছরে ২৬ হাজারের বেশি মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে মৃতু্যবরণ করেন। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি জন্য বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সচেতনতা সপ্তাহ। তাই এ বিষয়ে জ্ঞান খুবই জরুরি।
অ্যান্টিবায়োটিক এক ধরনের জৈব রসায়নিক ঔষধ, যা অনুজীবদের (ব্যাক্টেরিয়া) নষ্ট করে বা বংশ বিস্তার রোধ করে। সাধারণত একেক অ্যান্টিবায়োটিক একেক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অনুজীবদের বিরুদ্ধে কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া নিজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে না বিধায় নিজেদের অঞ্চল থেকেই তাদের খাদ্য সংগ্রহ করার কারণে তারা একই অঞ্চলে থাকা অন্য ব্যাকটেরিয়াগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এক ব্যাকটেরিয়া আরেক ব্যাকটেরিয়াকে মারার জন্য এন্টিবায়োটিক তৈরি করে। এই অ্যান্টিবায়োটিকই আমরা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করি।
অ্যান্টিবায়োটিক শুধু কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসা করে, যেমন স্ট্রেপ থ্রোট, মূত্রনালীর সংক্রমণ এবং ই.-কোলাই। কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রয়োজন নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সাইনাস সংক্রমণ বা কিছু কানের সংক্রমণের জন্য আপনার তাদের প্রয়োজন নাও হতে পারে। প্রয়োজন না হলে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা আপনাকে সাহায্য করবে না বরং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। আপনি অসুস্থ হলে আপনার হেলথকেয়ার প্রফেশনাল যেমন : ডক্টর বা ফার্মাসিস্ট আপনার জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনার সরবরাহকারীকে আপনার জন্য একটি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিতে বলবেন না কখনই।
অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাল সংক্রমণে কাজ করে না। উদাহরণস্বরূপ : আপনার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয় : সর্দি এবং কাশি এমনকি যদি শ্লেষ্মা ঘন, হলুদ বা সবুজ হয়, বেশিরভাগ গলা ব্যথা (স্ট্রেপ থ্রোট বাদে), ফ্লু, ব্রঙ্কাইটিসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকে নামেমাত্র জ্বর হলেই খুব শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা শুরু করে, যা কোনোভাবেই উচিত নয়। কেননা জ্বর বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তাই কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার বন্ধ করুন।
অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছোট থেকে খুব গুরুতর পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত যেমন : ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, ইস্টের সংক্রমণ।
আরও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে পারে : সি. ডিফ ইনফেকশন, যা ডায়রিয়া ঘটায় যা মারাত্মক কোলনের ক্ষতি এবং কখনো কখনো মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে। মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী এলার্জি প্রতিক্রিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে সম্প্র্রতি যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ৭২টি দেশের নদীর নমুনা গবেষণা করে দেখেছে যে নদীর পানিগুলো ৬৫ শতাংশ এন্টিবায়োটিক দ্বারা দূষিত। আর এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সব থেকে শোচনীয় বলে ধারণা করা হয়েছে! এই পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বা এই পানির মাছ থেকে আমাদের দেহে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শরীরে প্রবেশ করছে এবং আমাদের দেহে গঠিত হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক বিরোধী প্রতিরোধ। গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে ২০৫০ সালে ১০ মিলিয়ন মানুষ এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে মারা যাবে, যা ক্যান্সার কিংবা এইডসসহ অন্য যে কোনো রোগের তুলনায় অনেক বেশি (ফব কৎধশবৎ, ২০১৬; ঝঃবধিৎফংড়হ, ২০১৬; ঐধৎনধৎঃ, ২০১৬)। এছাড়াও ২০১৯ সালে ১২ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ মারা গেছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য।
অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, যা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই ক্ষেত্রে ঔষধ খেয়েও ভালো ফল পাওয়া যায় না। কারণ জীবাণুর বিপক্ষে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করতে পারে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনে অথবা অতিরিক্ত এ্যান্টিবায়োটিক সেবনে শরীরের ক্ষতিকর জীবাণু তার নিজের জিনেটিক কোডে এমন পরিবর্তন আনে যে সেই এন্টিবায়োটিক তার তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
কারণসমূহ : মাত্রাতিরক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা, রোগীদের নির্দিষ্ট চিকিৎসাব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে শেষ না করা, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে জীবাণু নিয়ন্ত্রণের অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যবিধির অভাব ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, গৃহপালিত পশুপাখি পালনে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার, নির্দিষ্ট রোগের জন্য সঠিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের অভাব।
আবার আমরা যা খাই, সবজি, ফল বা মাছ মাংসের মধ্যে থেকে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে থাকে। এছাড়া মুরগির মাংস, গরু বা খাসির মাংস, দুধ এবং দুগ্ধ জাতীয় খাবার, মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেখানেও এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। রোগ প্রতিরোধী করার জন্য, শাক-সবজি যদিও এতে সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় না। তবে কীটনাশক দেওয়া হয়। তবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মূল কারণ ফার্মাসিস্টবিহীন অবৈধভাবে ফার্মেসি ব্যবসা, লাইসেন্সবিহীন ওষুধের ব্যবসা। অত্যন্ত দুঃখজনক গ্রামের চায়ের দোকানেও ঔষধের ব্যবসা হয় এখন। যেখানে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টের পরামর্শ ব্যতিত ঔষধ সেবন করছেন সাধারণ রোগীরা। ওষুধের অপব্যবহারের কারণে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে ভবিষ্যতে রোগ মুক্তির জন্য ঔষধ পাওয়াটা দুঃসাধ্য। তাই সচেতনতার লক্ষ্যে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট ব্যতিত ঔষধ ক্রয়-বিক্রয় সেবন বন্ধ করুন। এই ডাক্তারের ওপর ডাক্তারি ফলাতে গিয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি। আর তাই এখন নিউমোনিয়া, টিবির মতো রোগগুলো সারছে তো নাই উল্টে রোগীকে আস্তে আস্তে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বই এই অভিশাপের গ্রাসে পড়েছে। কিন্তু সবচাইতে যেটা বেশি চিন্তার তা হলো এই রিপোর্টেই ভারতসহ এশিয়ার বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ইত্যাদি দেশকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই প্রবণতাকে থামাতে গেলে কিছু গঠনমূলক ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে; যেমন-
ঙ্ কঠোর আইনের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেওয়াকে বন্ধ করতে হবে।
ঙ্ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ঙ্ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এন্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহের মতো নিজ নিজ দেশেও এই রকম সচেতনতা অভিযান চালানো।
ঙ্ চিকিৎসা ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মানুবর্তিতা পালন হচ্ছে কিনা তা গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে।
ঙ্ নিজের এবং নিজের চারপাশের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
ঙ্ মাঝপথে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজে ডাক্তারি না ফলিয়ে, বরং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারের পরার্মশ অনুযায়ী কোর্স কমপিস্নট না হওয়া অবধি ওষুধ খেয়ে যান।
ঙ্ কৃষিক্ষেত্র এবং গৃহপালিত পশুপাখির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে অনাবশ্যক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
ঙ্ ওষুধের ব্যবহার হয়ে গেলে যত্রতত্র তার খাপ বা মোড়ক ফেলে দেওয়ার থেকে নিজেদের বিরত রাখা।
মনে রাখবেন, ওষুধ যেমন রোগ থেকে মুক্তি দেয়, ঠিক তেমনিভাবে ভুল, অপ্রয়োজনে, অতিমাত্রায় কিংবা ডোজ শেষ না করে ওষুধ সেবন নিশ্চিত মৃতু্য ঝুঁকি ও মহামারী ও ভয়ানক রোগ ডেকে আনে। ওষুধকে দয়া করে প্রতিদিনের খাদ্য বস্তু ভাতের মতো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঔষধ সেবন একপ্রকার স্ব-ইচ্ছাই বিষ সেবন করা।
অবৈধভাবে, লাইসেন্সবিহীন, ফার্মাসিস্ট ব্যতিত ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। ইহা রাষ্ট্রদ্রোহ, মানবতাবিরোধী, হত্যাযোগ্য অপরাধ। তাই আসুন, সবাই মিলে নিজে বাঁচি, অন্যকেও নিজের পরিবারকে বাঁচাতে সহয়তা করি। তাই পরিবর্তনের শুরুটা হোক নিজের কাছে থেকে। কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিককে না বলি।
আল মাসুম হোসেন
শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ
কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়