শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের করণীয়

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বাংলাদেশের অধিকাংশ সমস্যা যেমন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ট্যাক্সেশন অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীল সুদ ও বিনিময় হার, রিজার্ভের অপর্যাপ্ততা, মানি লন্ডারিং, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, জনশক্তির অভাব, পণ্য বিপণনে সমস্যা ও অসম প্রতিযোগিতা দূর হয়ে যাবে।
মো. মাসুদ চৌধুরী
  ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের করণীয়

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সংকটে বৈদেশিক বিনিয়োগ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৯৮০-র দশকের ল্যাটিন আমেরিকান আর্থিক সংকট, ১৯৯৪-৯৫ সালের মেক্সিকান সংকট, ১৯৯৭-৯৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারি সংকট পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ইমপেরিকেল রিসার্চগুলো বলছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি দেশের মোট বিনিয়োগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, রপ্তানি উদারীকরণ এবং প্রযুক্তিগত স্পিলওভারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে থাকে। তাই বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকর্ষণ করতে বেশিরভাগ দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। এই প্রতিযোগিতা আরও কয়েক গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে; গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে। ২০২২ সালে ইউক্রেনের যুদ্ধ, উচ্চ খাদ্য ও জ্বালানির দাম এবং ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ১২ শতাংশ কমে ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছিল- যা ২০২৩ সালে এসে আবার ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও মন্থর বিশ্ব অর্থনীতির কারণে। সেজন্য বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য বেশিরভাগ দেশই তাদের জাতীয় নীতি নতুনভাবে প্রণয়ন করছেন।

বাংলাদেশ সরকারও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছেন। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাই-টেক পার্ক এবং ওয়ানস্টপ ডিজিটাল সার্ভিস সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টারই ফসল। তাছাড়া, বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন রাজস্ব ও অ-আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, করপোরেট আয়কর ছাড়/কমানো, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর আমদানি কর হ্রাস, ভ্যাট হ্রাস, রপ্তানি ভর্তুকি প্রদান, বিভিন্ন ব্যাংকিং সুবিধা এবং বিশেষাধিকারের ব্যবস্থা করেছেন। আবার বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি (বিডা) ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) কারিগরি সহায়তায় বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের লক্ষ্যে সংস্কারের সমন্বয় করছেন। এয়াড়া, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য, কাগজ, হিমায়িত খাদ্য, পর্যটন, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিংয়ের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পে রয়েছে বৈদেশিক বিনিয়োগের অফুরন্ত সুযোগ ও সম্ভাবনা। ভারী ও তথ্যপ্রযুক্তির শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

তারপরও বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০২৪ অনুসারে, ১৯৯০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ সব সময় ওঠানামা করেছে। ২০১৫ সালে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২.২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ওঠানামা করে ২০১৯ সালে এসে দাঁড়ায় ২.৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২০ সালে তা ২০১৯ থেকে ১২.১০% কমে হয় ২.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ ও ২০২২-এ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ (যথাক্রমে ২.৯০ এবং ৩.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বৃদ্ধি পেলেও ২০২৩ সালে আবার ১৬ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৩.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার- যা বাংলাদেশের বার্ষিক নমিনাল জিডিপির মাত্র ০.৩৪৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ রূপান্তর হতে হলে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ১.৬৬ শতাংশ হতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ কখনো বার্ষিক জিডিপির ১.০০%-এ উন্নীত হয়নি।

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য বিনিয়োগের পরিবেশের অনুপস্থিতি। বিশ্বাসযোগ্য বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার পেছনের কারণগুলো হচ্ছে দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, ট্যাক্সেশন রেগুলেটরি ও পলিসি অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীল সুদ ও বিনিময় হার, রিজার্ভের অপর্যাপ্ততা, মানি লন্ডারিং ও সিন্ডিকেট বাণিজ্য। তাছাড়া, দক্ষ জনশক্তির অভাব, পণ্য বিপণনে সমস্যা, যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তার অভাব, অসম প্রতিযোগিতা এবং চাহিদার তুলনায় গ্যাসের কম সরবরাহ বৈদেশিক বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে।

তাছাড়া, বিশ্বের তিনটি প্রধান সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং সংস্থা (ফিচ রেটিং, এসঅ্যান্ডপি গেস্নাবাল রেটিং এবং মুডি'স রেটিং) যাদের 'বিগ থ্রি' ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি বলা হয়ে থাকে তারা বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। মে, ২০২৪-এ ফিচ রেটিং বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ইসু্যয়ার ডিফল্ট রেটিংকে 'বিবি মাইনাস' থেকে 'বি পস্নাস'-এ ডাউনগ্রেড করেছে- যা এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার। এর আগে সেপ্টেম্বরে ২০২৩-এ বাংলাদেশকে স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক ঋণমান দিয়েছিল ফিচ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন রোধ এবং ডলারের সংকীর্ণতা সমাধানের জন্য ২০২২ সালে নেওয়া নীতিগত পদক্ষেপগুলোর অপর্যাপ্ততা এবং ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রা বাজার পরিস্তিতি মোকাবিলা ও রিজার্ভ গঠনের অনিশ্চয়তা এই ঋণমান অবমাননার অন্যতম কারণ। এর এক মাস পর, জুলাই, ২০২৪-এ, এসঅ্যান্ডপি গেস্নাবাল রেটিং বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং 'বিবি মাইনাস' থেকে 'বি পস্নাস'-এ ডাউনগ্রেড করেছে- যার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাগত কমে যাওয়া।

নভেম্বর, ২০২৪-এ মুডি'স রেটিং বাংলাদেশেকে 'বি-১' থেকে 'বি-২' এ নামিয়ে এনেছে। দেশের অর্থনীতির পূর্বাভাসও 'স্থিতিশীল' থেকে 'ঋণাত্মক' বা 'নেতিবাচক' হিসেবে চিহ্নিত করেছে এই মার্কিন রেটিং সংস্থাটি- যা ১৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম। এই রেটিং পাওয়ার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সরকারি তারল্য ঝুঁকি, বাহ্যিক দুর্বলতা ও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি। একই সঙ্গে নভেম্বের, ২০২৪-এ ব্যাংক আল-ফালাহ লিমিটেড (বিএএফএল)-এর শ্রীলংকার হ্যাটন ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি (এইচএনবি)-এর কাছে বাংলাদেশের কার্যক্রম বিক্রির জন্য নীতিগত অনুমোদন পাওয়া বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কাছে খারাপ বার্তা প্রদান করছে। তাই সবকিছু বিবেচনায় বাংলাদেশের বিনিয়োগের পরিবেশ বৈদেশিক বিনিয়োগেকারীদের প্রতিকূল থাকায় বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন- যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। তাই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক বিনিয়োগ গ্রহণে এর অবস্থান চতুর্থ (সূত্র : আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০২৩)।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে একটি বিশ্বাসযোগ্য বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার জন্য অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রূপরেখা প্রণয়নও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। সেইসঙ্গে সব রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের দল গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের সমস্যাগুলো সমাধানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে থেকে কাজ করতে হবে। এছাড়া, বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো হবে- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, গ্রহণযোগ্যতা, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনবান্ধব প্রশাসন ও সমতা।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বাংলাদেশের অধিকাংশ সমস্যা যেমন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ট্যাক্সেশন অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীল সুদ ও বিনিময় হার, রিজার্ভের অপর্যাপ্ততা, মানি লন্ডারিং, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, জনশক্তির অভাব, পণ্য বিপণনে সমস্যা ও অসম প্রতিযোগিতা দূর হয়ে যাবে।

\হএকই সঙ্গে 'বিগ থ্রি' ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি দ্বারা বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিংয়ের উন্নীত হবে- যা বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবে। তাছাড়া, বাংলাদেশ সরকারকে নিজস্ব, বৈদেশিক বা যৌথ অর্থায়নে অবকাঠামোগত ও শ্রমশক্তির উন্নয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং অথোরিটি (বেপজা), কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্সকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। পরিশেষে, ভার্চুয়াল মিডিয়াসহ সব মিডিয়াতে বাংলাদেশের ভালো ইমেজ তৈরি করতে সরকারসহ আমাদের সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

মো. মাসুদ চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে