বাংলাদেশে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা জরুরি
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড। এই শিল্পায়নের যুগেও বাংলাদেশ কৃষির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক কৃষির সঙ্গে তুলনা করলে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
প্রকাশ | ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বিপুল চন্দ্র রায়
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের জনগণ কৃষিকাজে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এ দেশের জনগণের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে কৃষকেরাই- কৃষি পণ্য উৎপাদন করে। তবে, ছোট একটি দেশে ১৬ কোটি জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়; খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন কৃষির ব্যাপক আধুনিকীকরণ। যে দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিজীবী, সে দেশের উন্নয়ন করতে হলে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন করতে হবে। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার না করে একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কৃষকদের কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও আগ্রহী করে তোলা এবং সেগুলো যথাসম্ভব সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবারহ করা। জমি প্রস্তুতকরণ থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই পর্যন্ত সব প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিকীকরণ হলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন। এর ফলে, সময় ও খরচেরও সাশ্রয় হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমে যাবে।
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান বলা হলেও এ দেশের কৃষকরা বরাবরই সবকিছু থেকে অবহেলিত। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দকৃত নানান সুযোগ-সুবিধা থাকলে ও তৃণমূল পর্যায়ে খুব সামান্যই বরাদ্দ। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাজেট অন্যান্য খাতে বরাদ্দকৃত বাজেটের তুলনায় অনেক কম রাখা হয়। যেমন : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল মোট বাজেটের ৭.৮ শতাংশ। এবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ৫.৯ শতাংশ- যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় অনেক কম। আবার কৃষি খাতের ভর্তুকির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতে ভর্তুকি ছিল মোট বাজেটের ৩.৬ শতাংশ। পরবর্তী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ কমে মোট বাজেটের ২.২ শতাংশ- যা বিগত বছরের তুলনায় অনেকাংশে কম। কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকদের উন্নয়নের স্বার্থে এবং কৃষকের কাজে প্রগতি আনতে বাংলাদেশের কৃষকদের ভর্তুকি ও কৃষি ঋণ সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়া ব্যবস্থা করতে হবে তবেই কৃষিতে উন্নয়ন হবে কৃষিতে বিপস্নব ঘটবে। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের আবাদযোগ্য ৮৫ শতাংশ ভূমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার ধরে রাখার জন্য জমির পুষ্টি ও উর্বরাশক্তির বিষয়ে এখনই বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে। জমি থেকে দীর্ঘমেয়াদে ফসল উৎপাদন ধরে রাখতে জমিতে রাসায়নিক সারের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার ছাড়াও ফসল আবাদে বহুমাত্রিকতার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া বিকল্প টেশসইয়ের কোনো উপায় নেই। এছাড়া, প্রতিকূল পরিবেশে উপযোগী প্রযুক্তি ও উৎপাদন কৌশল, হাইব্রিড শস্যের প্রসার, পানি সাশ্রয়ী সেচ পদ্ধতি, সার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি রোধে ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নতুন জাত, ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। জমির উর্বরাশক্তি ধরে রাখা এবং ফসলের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। টেকসই কৃষি ব্যবস্থার লক্ষ্যে আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা জরুরি। কৃষিকাজের সঙ্গে আবহাওয়ার নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। উন্নত দেশে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে সে এলাকার বিগত কয়েক বছরের আবহাওয়া বিবেচনা করে উপযুক্ত ফসলের জাত বাছাই করে রোপণ করা হয়। যেহেতু কোনো এলাকার আবহাওয়া, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, শিশির, বাষ্পীভবন, তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, মাটির গুণাগুণ এবং সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে ওই এলাকার জন্য উপযুক্ত ফসলের জাত নির্বাচন করা।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড। এই শিল্পায়নের যুগেও বাংলাদেশ কৃষির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক কৃষির সঙ্গে তুলনা করলে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
\হবাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও ধান উৎপাদনে আমরা ভিয়তেনাম, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। শুধু পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশের বাজারে শুধু যে বাংলাদেশের পণ্যই পাওয়া যায় তা নয়, প্রতিবেশী দেশের পণ্যও বাজারে প্রবেশ করেছে। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হয়। একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে বাজার ব্যবস্থাকে আরও উন্নত, আধুনিক এবং সময়োপযোগী করে তুলতে হবে। তাই আগামীর কথা চিন্তা করে দেশে এখন থেকেই টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হচ্ছে সময়ের দাবি। কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ, আমার সোনার বাংলাদেশ।
বিপুল চন্দ্র রায় : কলাম লেখক