ভয়কে জয় করলে প্রশান্তি অনিবার্য

মানসিক আসক্তি ও উদ্বিগ্নতা থেকে নানা ক্ষতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শতদল বড়ুয়া
মানবজীবন নানা আতঙ্ক- তথা ভয়ে ভরপুর। ভয়কে জয় করতে হলে নিজের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট। আতঙ্ক বা ভয় হচ্ছে স্বার্থপরতা এবং অজ্ঞানতার বরপুত্র। যা ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করে থাকে। আমাদের পারিপার্শ্বিক সর্বত্র ভয়। অভাবের ভয়, আজকে যা পাচ্ছি তা আগামীতে না পাওয়ার ভয়, রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, বৃদ্ধ বয়সে মৃতু্যর ভয়, অজানা আশঙ্কার। আরও কত রকমের ভয়ের মধ্যে আমাদের জীবনমান চলছে- তা লিখে শেষ করা যাবে না। আতঙ্ক বা ভয় আমাদের জীবনকে খান খান ভেঙে দেয়। মনমানসিকতা ঠিক থাকে না। দুঃখময় এজগতে হতাশা প্রবণ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অনাগত দিনগুলোকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। কেউ যদি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয় তবেই সে বুঝতে পারবে চিন্তাধারায় কত অশান্তি বিরাজমান। সহসা সে তার সব ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে এবং এ ভীতি তাকে ভূস্বামী থেকে ভূতে রূপান্তরিত করে। মোট কথা- আমাদের ওপর ভয়ের একটা প্রভাব বিদ্যমান। খোলামেলাভাবে এটাই বুঝি- ভয়, আতঙ্ক সবার জন্য অন্তরায়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা অবলোকন করে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছি। যেমন বলতে পারি- অপ্রীতিকর পরিবেশের ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি, অশুভ আত্মার ভয়, ভূত ও ঈশ্বরের ভয়, ধর্মীয় ভয়ও কিন্তু আমাদের মাঝে সক্রিয়। কোনো কোনো ধর্মে শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রকাশের নিয়ম না জানার ভয়। ভয় আমাদের মনকে যেমন বিচলিত করে তেমনি অক্টোপাসের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে আমাদের। ভয়কে কুসংস্কারের জন্মদাতা বলা যেতে পারে। মানুষ কুসংস্কারের বশবতী হলে উচ্চ আকাঙ্ক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এতে অলৌকিক শক্তির প্রবণতা বেড়ে যায়। মানুষ রহস্যের জালে বন্দি। এই অনুদ্ঘাটিত প্রকৃতিই সর্বাগ্রে বিশ্বাসের উৎপত্তি ঘটায়। আমাদের লালিতও অজ্ঞানতা আতঙ্কের প্রথম কারণ হতে পারে। নেপোলিয়ন হীলের ভাষায়- অভাবের আতঙ্ক সন্দেহাতীতভাবে ছয়টি মৌলিক উপাদানে গঠিত। তা হলো- অভাব, সমালোচনা, রুগ্নতা, প্রিয় বিচ্ছেদ, বার্ধক্য এবং মৃতু্য। মানুষের ক্ষেত্রে অভাবের আতঙ্ক পুরোভাগে বিদ্যমান। এরূপ পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনা বড় দুরূহ ব্যাপার। ভয়ের উৎপত্তিস্থল ব্যাখ্যা করতে অসীম সাহসের প্রয়োজন। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ব্যাখ্যা করা সত্যকে গ্রহণ করতে রাজি হওয়া। মানুষের সহজাত প্রবণতা থেকে আতঙ্ক উৎপন্ন হয়। দরিদ্রতার আতঙ্ক মানুষের জন্মগত প্রবণতা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ধন-সম্পদ বৃদ্ধির জন্য অন্যের ধন-সম্পদের ওপর লজ্জাজনক দৃষ্টি পড়ে। একমাত্র মানুষ ছাড়া প্রায় সমস্ত জীবের সহজাত প্রেরণা এবং চিন্তাধারার ক্ষমতা খুবই সীমিত। যার পরিপ্রেক্ষিতে এরা অন্যের ওপর শারীরিক আক্রমণ করে ক্ষুধার জ্বালা মেটায়। মানুষ উন্নতর অনুভূতির কারণে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকায় আহারে-বিচারে বুদ্ধি প্রয়োগ করে একে অপরকে শারীরিকভাবে আহার করে না বটে, অন্যের ধন-সম্পদ কৌশলে কুক্ষিগত করে অধিকতর সন্তুষ্টি লাভ করে। মানুষ অতিরিক্ত ধন-সম্পদ লিপ্সু বিধায় প্রতিটি কল্পনাসাধ্য আইন সবার নিরাপত্তা বিধানের জন্য চিন্তা করা যেতে পারে। আতঙ্ক বা ভয় থেকে মুক্ত থাকতে হলে খোলামেলা মনে সবকিছুর মোকাবিলা করতে হবে। শিশু হিসেবে আমরা দু'টি জিনিসকে ভয় পাই। উপর থেকে পড়ে যাওয়া এবং বিকট শব্দ। যখন শিশুদের পরিকল্পনার ছক তৈরি করে দিয়ে নিজেকে নিজে বুঝার ক্ষমতা অর্জন করতে সমর্থ করে দেওয়া। যতক্ষণ না তারা কোথায় কখন কি করতে হয় তা স্বতন্ত্রভাবে বুঝাতে সক্ষম না হয়। শুধু নিজের বেলায় নয়, অন্যেরও সামান্যতম হলেও স্বাতন্ত্রতা বোধের উদ্ভব হলেই বুঝতে হবে কষ্টের কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে। ভয় বা আতঙ্ক সব বয়েসি মানুষের পেছনে পেছনে ধাবিত হয়। হিংস্র জন্তুর ভয়, শত্রম্নর ভয়, প্রাকৃতিক দৈব দুর্যোগের ভয়, অজানা ভয়, আকাশে বিদু্যৎ চমকানোর ভয় ইত্যাদি। এ সমস্ত বিষয় মোকাবিলায় নিজের সিদ্ধান্তই ফাইনাল। কোনটা আগে, কোনটা পড়ে তা নির্ধারণ করতে হবে নিজেকে। আবহমানকাল ধরে আতঙ্কিত হৃদয়ের মানুষ এভাবেই সংগ্রাম করে আসছে। জ্ঞানী এবং শিক্ষকরা তাদের জীবন সংগ্রামের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পরামর্শ দেয় কীভাবে ছেলেমেয়েদের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। ছেলেমেয়েরা কঠিন রোগেও মরবে না, দেব-দেবীর রোষানলে বলি হতে হবে না। অপরিচিত লোকের হাতে জীবনহানির আশঙ্কা থাকবে না। এভাবে নিশ্চয়তার আশ্বাসের মাধ্যমে ভয়ের মাত্রা অনেকটা কমানো যায়। আমাদের প্রশংসা করতে হয় যে, বুদ্ধিমত্তা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি সুনিয়ন্ত্রিত সভ্য সমাজে বসবাস করার যোগ্যতা অর্জন করেছি। এতে ভয়ও অনেকটা কমে যায়। আমরা প্রকৃতির স্বরূপ ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হই। এতে আমাদের আতঙ্কও কমতে থাকে। আমাদের বোধশক্তি দিয়ে আতঙ্ক থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। আদিম জাতিরা ভয়ংকর হিংস্র জীবজন্তু দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত, বিদু্যৎ চমকানো, ভূমিকম্প, অগ্নু্যৎপাত, রোগবালাই ইত্যাদির নিকট বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে কাল্পনিক শক্তির কাছে পরিত্রাণ প্রার্থনা করত। এখানেই আদিম জাতি এবং জীবজন্তুর মধ্যে পার্থক্য। তার নিজের সচেতনতা শক্তির বাইরে সে যা চিন্তা করে তাকেই সে প্রার্থনার মাধ্যমে উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয় কোনো কাল্পনিক শক্তির বেদিতে। আদিম জাতি এভাবেই তার প্রার্থনার জগতকে ক্রমে প্রসারিত করতে করতে এক সময় সেই প্রকৃতিই তাদের হৃদয় মন্দিরে দেবতার আসন লাভ করে। তখন সুশক্তির প্রতীকসমূহ তাদের কাছে সুদেবতা হিসেবে গণ্য হয়। কুশক্তিসমূহ অপদেবতা হিসেবে মনে করে। আদিমকালের সেই অন্ধকার যুগে বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রাম করতে করতে কুসংস্কারের বীজ মানুষের মনে বিস্তার ঘটাতে শুরু করে। উত্তরাধিকারী সূত্রে আদিমকাল থেকে এখনো পর্যন্ত এ সমস্ত কুসংস্কার আমাদের সমাজে বিষফোঁড়ার মতো বিদ্যমান। প্রশান্তির এই কাল্পনিক শক্তিকে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই বলতে হয়, যারা প্রকৃতির নিয়মকানুন বুঝতে অক্ষম, তারাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়। ভয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বোকাদের মনেই উৎপন্ন হয়, বুদ্ধিমানদের মনে নয়। ভয় মানুষের মানসিক অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের মনকে সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত করা যায়। মনের নেতিবাচক ব্যবহারই আতঙ্কের হেতু। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ইতিবাচক ব্যবহার সামগ্রিক বিষয় আর অভিরুচি সবই আমাদের একান্ত বিষয়। প্রত্যেক মানুষের মনকে সংযত রাখার ক্ষমতা নিজেদের রয়েছে। প্রকৃতি মানুষকে একটি বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করেছে। সেটি হলো- আমাদের স্ব-স্ব চিন্তা। তাই মানুষের সূচিত প্রত্যেক ঘটনা অন্যান্য সত্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে তাকে মূলত্ত্বের দিকে পরিচালনা করে। যার দ্বারা ভয় অপসারিত হয়। একজন ব্রিটিশ এনাটোমিস্টকে (জীবদেহের গঠন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ) এক ছাত্র প্রশ্ন করেছিল- আতঙ্ক উপশমের উপায় কি? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, কারো জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করা। ছাত্রটি আবার বলল, আপনার নির্দেশনার ওপর আর একটু জানতে চাই। তখন তিনি বললেন, 'তুমি একই সময়ে দুইটি বিষয়ে পরস্পর বিরোধী চিন্তা মনের মধ্যে পোষণ করতে পারবে না। কারণ একটা চিন্তা আর একটা চিন্তাকে বিতাড়িত করে। উদারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, তোমার মন যখন সম্পূর্ণরূপে অন্যের উপকার চিন্তায় নিমজ্জিত হবে সে সময় ভয়নামক দানবটি মনকে আচ্ছন্ন করতে পারবে না। মানসিক আসক্তি ও উদ্বিগ্নতা থেকে নানা ক্ষতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অশান্তির প্রবণতা ধীরগতিতে স্রষ্টার প্রতি অনুসরণের মনমানসিকতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে, মনের স্বাভাবিক প্রশান্তিকে বিঘ্নিত করতে পারবে না। চিকিৎসক এলেন জিক্স বলেন, হিংসা, বিদ্বেষ, ভয় যখন অভ্যাসে পরিণত হয় তখন প্রকৃত রোগব্যাধির বিস্তার ঘটে। দুঃশ্চিতা দেহযন্ত্রকে বিকল করে দেয়। নৈতিক দুঃখ প্রগাঢ়ভাবে স্বাস্থ্যের বিঘ্ন ঘটায়। যারা গভীরভাবে অন্তরে শান্তি লালন করে তারা আধুনিক কোলাহলপূর্ণ নগরীতেও চঞ্চলতা এবং শারীরিকভাবে বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। মানুষের চলমান জীবনটা অতীব গুরুত্ববহ। এত কিছু আমরা ভাবি না বলে অশুভ শক্তিও আমাদের পিছু ছাড়ে না। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রেখে জীবন চলার পথে অবিচল থাকতে পারলে ভয় বা আতঙ্ক আমাকে-আপনাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না। সবার প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্দর ও স্বার্থক হোক, পরিশেষে এ কামনাই করছি। শতদল বড়ুয়া :প্রাবন্ধিক