ভারী শিল্প অবকাঠামো, কলকারখানা, জনবসতি, হাটবাজার, বিদু্যৎ প্রকল্প, মাছের ঘের, রাস্তাঘাট গড়ে তোলার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে আমাদের বনাঞ্চলের ক্ষতি করছে। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করে আনতে হবে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর রয়েছে গুরুত্ব। নিজ নিজ বাস্তুসংস্থানে তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ। দেশের মানুষকে বাঁচাতে প্রথমে বাঁচাতে হবে তার প্রকৃতিকে। আর এ দেশের প্রকৃতিকে বাঁচাতে প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে সুন্দরবনসহ সব বন্য পরিবেশকে- যার মাধ্যমে টিকে থাকবে অসংখ্য প্রাণী। এভাবেই রক্ষা হবে পরিবেশের ভারসাম্য। শুধু পরিবেশগত কারণেই না, এ দেশের জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে হবে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলেও। অসচেতনতা এবং নানাবিধ কারণে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবকুল। খেয়াল করলে দেখা যাবে বাঘের আবাসস্থল ক্রমেই তাদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলেও অনেকে মনে করছেন। অপরিকল্পিত পর্যটনেরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। তাই তাকে বাঁচাতে নিতে হবে সঠিক আইনের পদক্ষেপ। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য মানুষ সচেতন হচ্ছেন সেখানে আমাদের দেশের কিছু মানুষ বন্যপ্রাণী হত্যার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। গত ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং এলাকায় একটি হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। হাতিটিকে তিন বা চার দিন আগে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফসল রক্ষার জন্য পেতে রাখা বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে ১৫ বছর বয়সি হাতিটি মারা যায়। আবার সে বছরের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের একটি ধানক্ষেত থেকেও উদ্ধার করা হয় একটি হাতির মৃতদেহ। এই হাতিটিকেও বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে মারা হয়েছিল। বিডিনিউজ সূত্রে আরো জানা যায়, গত ৯ নভেম্বর কক্সবাজার বন বিভাগের ঈদগাঁও রেঞ্জের পূর্ণগ্রাম বিটের আওতাধীন এলাকায় গুলি করে মারা হয় ১২ বছর বয়সি আরেকটি হাতি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ৪৩টি হাতি। যার মধ্যে ১৬টি চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো বান্দরবান ও কক্সবাজারে।
শিল্পায়নের কারণে বায়ুমন্ডলে ব্যাপকভাবে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ম মোতাবেক কলকারখানা গড়ে না ওঠায় এ বিপত্তি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পুরাতন রোগ্ন শিল্পকারখানাগুলো আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে যেমন দূষণরোধী প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারছে না, তেমনি নতুন কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে আইনকানুন সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না। বিবেকহীন মানুষ নিজের সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য অরণ্য উচ্ছেদের নেশায় মেতে উঠেছে। অরণ্যের বিস্তার যত কমছে বন্যপ্রাণীরা ততই হারাচ্ছে তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের অধিকার। জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু বিরল প্রজাতির প্রাণী।
প্রকৃতির সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীলতামূলক সহাবস্থানের চিরাচরিত নীতি থেকে সরে এসে একতরফাভাবে নিজের প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো মানুষ তাকে ব্যবহার করা শুরু করেছে। ফলে, বন ও বন্যপ্রাণীদের ওপর শুরু হয়েছে যথেচ্ছাচার, অবারিত অনিয়ন্ত্রিত শোষণ। পৃথিবীতে প্রকৃতির ভারসাম্য তাই আজ দাঁড়িয়েছে সংকটের মুখোমুখি। প্রকৃতিকে এই সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারলে সভ্যতার টিকে থাকাও অসম্ভব। বনবিহীন বন্যপ্রাণীদের বংশ বিস্তার থেকে শুরু করে স্বাভাবিক বিচরণের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বনরক্ষা ভিন্ন অন্য কোনো বিকল্প নেই। সৃষ্টির আদিতে মানুষের পথ চলা শুরু হয়েছিল গাছপালা এবং বন্য পশুপাখিদের সঙ্গে একসঙ্গেই।
\হআগে বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে জঙ্গলে সাপ, ব্যাঙ, বেজি, বনবিড়াল, খরগোশ, কাঠবিড়ালিসহ বিচিত্র প্রাণীর দেখা মিলত। কিন্তু বসতি ও কৃষিজমি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বনজঙ্গল উধাও হয়ে গেছে। তাছাড়া সরকারি বনাঞ্চল যেভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে সেখানে এদের আশ্রয় কতদিন মিলবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণের উপায় কী? বন্যপ্রাণী শিকারের প্রবণতা দূর করা দরকার। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বন সৃজনের কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ গোষ্ঠীর তথ্য মতে, আবাসস্থল ধ্বংস, বিশেষ করে বন উজাড়করণের ফলে ১৬০০ প্রজাতির মেরুদন্ডী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। পাখির মধ্যে লাল মাথাযুক্ত হাঁস ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে; অন্যদিকে, কালো তিতির, লাল মাথাযুক্ত শকুন, ঈগল, পেঁচা ও সাদা ঈগল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
শুধু নগরায়ণের প্রয়োজনে নির্বিচারে একের পর এক অরণ্য কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। চোরাচালানকারীদের কবে পড়ে বিভিন্ন মূল্যবান গাছ অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণীকুলের ধ্বংসের পেছনে অরণ্য ধ্বংসের অবদান সম্ভবত সব থেকে বেশি। বন্যপ্রাণীরা তাদের খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য বিশেষভাবে অরণ্যের ওপর নির্ভর করে থাকে। তাছাড়া ব্যাপক পরিবেশ দূষণের ফলে বিভিন্ন পতঙ্গ বিলুপ্তির গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে, অরণ্যের স্বাভাবিক প্রজনন পদ্ধতি ব্যাহত হচ্ছে। বন এবং বন্যপ্রাণী ধ্বংসের ব্যাপারে আলাদা করে আর কোনো আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বন জঙ্গলের ওপর মানুষের যথেচ্ছাচারের কথা আজ সর্বজনবিদিত।
\হবন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত আইনটি ১০ জুলাই, ২০১২ তারিখে রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে আরও জানতে পারি আইনটি বাংলা ভাষায় রচিত। আইনের ৬ ধারা মোতাবেক এই আইনের তফসিলে উলিস্নখিত বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণী, মাংস, ট্রফি, অসম্পূর্ণ ট্রফি, বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এসব হতে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা কোনো প্রকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের ৪১ ধারা মোতাবেক আরো উলেস্নখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা ওই অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করে থাকলে এবং ওই সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, ওই সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দন্ডে দন্ডিত হবেন।
আইনের ৩৬ ও ৩৭ ধারায় বাঘ, হাতি, চিতাবাঘ ইত্যাদি সম্পর্কে রয়েছে। আইনের ৩৬ ধারায় দন্ড- সর্বনিম্ন ২ বছর, সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ড ও সর্বনিম্ন ১ লাখ, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। সংরক্ষিত উদ্ভিদ সংক্রান্ত ৬নং ধারা লঙ্ঘন করলে ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এক বছরের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে। কথায় বলে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তবু আইনানুগ শাস্তির ভীতি দেখিয়ে হলেও দুর্বৃত্তদের সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও পরিকল্পিত অভিযান প্রয়োজন।
আমাদের রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চল এবং বয়ে চলা অসংখ্য নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয়- যা নানা প্রজাতির পশুপাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
এ দেশে ৩০-৩৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৫০ প্রজাতির পাখি ও ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অতি আহরণের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্রমশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আবাসস্থল ধ্বংস, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব এবং অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ প্রয়াসের কারণে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক বন্যপ্রাণীই বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে।
বিবিসির মাধ্যমে জানা গেছে, ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথমবারের মতো বাঘ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে অংশ নেয় বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ। পিটার্সবার্গের ওই সম্মেলনের পর ২০১৫ সালে আধুনিক ক্যামেরা টেপিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বাঘের জরিপ করে বন অধিদপ্তর। সঙ্গে ছিল ওয়াইল্ড টিম, যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়াম কনজারভেশন বায়োলজি ইনস্টিটিউট। সে সময় বাংলাদেশের সুন্দরবনে মোট বাঘ পাওয়া যায় ১০৬টি। সে হিসেবে বাংলাদেশ যদি তার প্রতিশ্রম্নতি রক্ষা করতে চায় তাহলে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা অন্তত ২০০টি বা তার আশপাশে রাখতে হবে। সবশেষ ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যায়, বাঘের মোট সংখ্যা ১১৪টি। অর্থাৎ তিন বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছ মাত্র ৮টি- যা অন্য দেশের অনুপাতে আশানুরূপ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন এর দ্বিগুণ সংখ্যক বাঘ ধারণ করার ক্ষমতা রাখলেও, শিকার ও হত্যা বন্ধ না হওয়ায় কোনোভাবেই বাঘের সংখ্যা বাড়ানো যাবে না। তাই যে যার অবস্থান থেকে দেশের বনজসম্পদ এবং বন্যপ্রাণীর প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অনুরোধ জানাব যেসব শিল্পের জন্য বনজসম্পদ নষ্ট করতে হয় সেসব শিল্পকে সম্ভব হলে নিরুৎসাহিত করুন।
রূপম চক্রবর্ত্তী :প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট