শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

সাহসী দেশপ্রেমিক মেজর এম এ জলিল

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
  ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সাহসী দেশপ্রেমিক মেজর এম এ জলিল
সাহসী দেশপ্রেমিক মেজর এম এ জলিল

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, সাহসী রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে বীর-উত্তম খেতাব প্রদান রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব ও মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সাহসী সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তার এই অধিকার সরকারের বাস্তবায়ন করা উচিত।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মেজর (অব.) এম এ জলিল। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের ভুলের কারণে মেজর জলিল বীর-উত্তম খেতাব থেকে বঞ্চিত হন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ ৯ মাস কারাবরণ করেন।

মেজর এম এ জলিল দেশের একজন সাহসী সন্তানের নাম। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ তাকে করেছিল লড়াকু এক সৈনিক। দীর্ঘ এক যুগ জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। আমৃতু্য সংগ্রামী জীবন তাকে করেছিল প্রতিবাদী, জালিম-শোষক ও লুটেরা শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন। বিপস্নবী চিন্তার পরিবর্তন ও ইসলামের চেতনায় উজ্জীবন তার মধ্যে পূর্ণতা এনেছিল।

অকুতোভয় দেশপ্রেমিক মানুষটির জীবন সম্পর্কে জানার কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রম্নয়ারি বরিশাল জেলার উজিরপুরে মামার বাড়িতে মেজর জলিলের জন্ম। জন্মের তিন মাস আগেই পিতা মারা যান। জন্ম নেন এতিম হয়ে। জন্মের পর থেকেই তিনি জীবনের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন। মায়ের স্নেহ-ভালোবাসাই ছিল তার জীবনে চলার পথের একমাত্র পাথেয়।

১৯৬০ সালে উজিরপুর ডবিস্নউবি ইনস্টিটিউশন থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুলজীবনেই 'পথের কাঙাল' ও 'রীতি' নামে দু'টি উপন্যাস লেখেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো- পরে পান্ডলিপি দু'টি হারিয়ে যায়।

১৯৬১ সালে জলিল ইয়াং ক্যাডেটে ভর্তি হন। পাকিস্তানের মারিতে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে কাকুলে সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কমিশন লাভ করে সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ১২ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

১৯৬৬ সালে মেজর জলিল পাকিস্তান সামরিক একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। পরে তিনি মুলতান থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি নেন। পড়াশোনার প্রতি তার একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

অসুস্থ মাকে দেখতে এক মাসের ছুটি নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রম্নয়ারি তিনি বাড়ি আসেন। ওই সময় জাতীয় রাজনীতিতে চলছিল কালো মেঘের আনাগোনা। ছুটির মেয়াদ শেষ হলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাননি। অত্যন্ত সচেতন মানুষটি রাজনীতির শেষ অবস্থা দেখার অপেক্ষায় থাকেন। এর মাঝে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে বসে নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর।

একদিন পর রেডিওতে শোনা যায় আরেকজন মেজরের কণ্ঠ, 'ও ধস সধলড়ৎ তরধ, যবৎবনু ঢ়ৎড়পষধরসং, ড়হ নবযধষভ ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, :যব ওহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংযৃ' ('আমি মেজর জিয়া, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি')। স্বাধীনতার এই আহ্বানে দেশকে মুক্ত করতে পাকিস্তানি বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন মেজর জলিল। একজন মেজরকে পেয়ে বরিশাল অঞ্চলের ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ তরুণরা আশাবাদী হয়ে ওঠে।

মেজর জলিলের ভাষণে উদ্দীপিত হয়ে যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মেজর জলিলকে বানানো হয় খুলনা, বরিশাল অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৯নং্বর সেক্টরের অধিনায়ক।

২৬ মার্চই মেজর জলিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল ও পটুয়াখালীকে মুক্ত অঞ্চল রাখতে সক্ষম হন। শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধা জলিলের জীবন। ৭ এপ্রিল মেজর জলিল খুলনা রেডিও সেন্টার মুক্ত করতে অপারেশন চালিয়েছিলেন।

২১ এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের পথ ধরে ভারতে চলে যান। ফিরে এসে ৯নং্বর সেক্টরের প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ত্যাগ আর কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া গেল স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ! ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা জাতি বিজয় পেল ১৬ ডিসেম্বর।

স্বাধীন দেশে বিজয় অর্জনের ২ সপ্তাহ পরে খুলনা থেকে যশোর হয়ে একটি প্রাইভেট কার ও একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা যাচ্ছেন ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা। যাদের মধ্যে ছিলেন ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত ৯নং্বর সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা কমান্ডার মেজর জলিল। বাকি সবাই ৯নং্বর সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধা, যারা দেশকে মুক্ত করতে বীরত্বের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছেন। বাধ্য করেছেন খুলনার পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে (১৭ ডিসেম্বর)। ছিলেন জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।

সকাল ১০টার দিকে তাদের বহন করা প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস যখন যশোর শহরে প্রবেশ করবে তখনই কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নং সেক্টরের আরেক দল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা পথরোধ করল তাদের। তাদের সঙ্গে থাকা অস্ত্র তাক করে পজিশন নিয়ে থাকা প্রায় ২০ জন মেশিনগানধারী মুক্তিযোদ্ধা।

মেজর জলিলের সঙ্গীরাও ছিল সশস্ত্র। তারা বন্দুক তাক করতে গেলে মেজর জলিল 'ডোন্ট ফায়ার' বলে থামিয়ে দেন তাদের।

যে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করলেন সেই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাত্র ২ সপ্তাহের মাঝে ৯নং সেক্টরের অধিনায়কসহ ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করা হলো! আটক করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় যশোর সার্কিট হাউসে।

মেজর জলিলকে আলাদা করে বাকিদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর সেখানে মেজর মঞ্জুর এলে মঞ্জুর ও মেজর জলিলের মাঝে তুমুল কথা কাটাকাটি হয়। 'আমাকে গ্রেপ্তার করার সাহস হলো কীভাবে, কে নির্দেশ দিয়েছে।' মেজর জলিলের এমন প্রশ্নের উত্তরে মেজর মঞ্জুর জানান, 'জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'

হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য, খুলনা জয়ের পর লুটতরাজ করা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন বক্তব্য ও পদক্ষেপের কারণে কোর্ট মার্শালে তার বিচার করা হবে। কিন্তু কেন গ্রেপ্তার কর হলো মেজর জলিলকে?

কেন স্বাধীন দেশের প্রথম রাজবন্দি করা হলো- একজন সেক্টর কমান্ডারকে! কেন এ রকম অভিযোগ আনা হলো!

এ নিয়ে খুব সরল উত্তর দেওয়া হয়- বিজয়ের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের ফেলে যাওয়া অস্ত্রসস্ত্র সব লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু জলিল এর জোড়ালো প্রতিবাদ করে; এর ফলেই ভারতীয় বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়।

কিন্তু উত্তরটা কি আসলেই এত সরল?

৯নং সেক্টরের স্টাফ অফিসার ওবায়দুর রহমান মোস্তফার লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা' বইয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

শুধু ভারত বিরোধিতা নয় বরং এর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে দ্বন্দ্বকে কারণ হিসেবে দেখেন অনেকে।

ব্রিটিশ আর্মির সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল আতাউল গনি ওসমানির প্রথাগত যুদ্ধ পদ্ধতির সঙ্গে তখনকার তরুণ সেক্টর কমান্ডারদের যুদ্ধকৌশল নিয়ে কয়েকবার মতবিরোধ হয়। মেজর জিয়া, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জলিলসহ সেক্টর কমান্ডাররা তো একবার জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এর ফলে, ওসমানী তখন পদত্যাগও করেছিলেন।

যদিও পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের অনুরোধে আবারও সেনাপতির দায়িত্ব নেন। কিন্তু আবারো মেজর জলিলের গেরিলা যুদ্ধকৌশল নিয়ে দু'জনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। জলিলের 'হিট রান' (আঘাত করেই পলায়ন) পদ্ধতি পছন্দ ছিল না জেনারেল ওসমানীর।

কলকাতায় ডেকে জলিলকে এ রকম ছোটখাটো গেরিলা আক্রমণের বদলে সম্মুখ আক্রমণের নির্দেশ দেন ওসমানী। কিন্তু জলিল সে নির্দেশ না মেনে গেরিলা আক্রমণই অব্যাহত রাখেন। ওসমানীকে টপকিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সম্মতি আদায় করে নেন।

কিছুদিন পরে মেজর জলিলের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্রিজ ধ্বংসে ক্ষুব্ধ হয়ে জেনারেল ওসমানী সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা এবং অপারেশনের নেতৃত্বে থাকা ক্যাপ্টেন বেগকে সবার সামনে তিরস্কার করেন। ব্রিজ ধ্বংসের কারণ বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল ওসমানী কোনো কথা শোনেননি।

এর কিছুদিন পরেই মেজর মঞ্জুরকে যশোর সদর দপ্তর থেকে ৮নং সেক্টরের পাশাপাশি ৯নং সেক্টরও দেখতে বলা হয়। মেজর জলিল তার গেরিলা যুদ্ধকৌশল ও সাহসিকতার জন্য ভারতীয় বাহিনীর কাছে বেশ আস্থাভাজন ছিলেন।

এমনকি ১৯৭১ সালের মে মাসে সুন্দরবনে পাকিস্তানি বাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে দুই লঞ্চ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ নষ্ট হয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর। এতে প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ মেজর জলিলকে সন্দেহ করলেও জেনারেল অরোরা ও দলবীর সিংয়ের আস্থা ও আশ্বাসে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।

বরং দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মেজর জলিলকে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত কলকাতা থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী ৯নং সেক্টর মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে রাখা হয়- যেখানে বেশ কিছু সেক্টরে অধিনায়ককে রদবদল হয়েছে। হয়তো এ কারণেই জলিলকে সরাসরি অপসারণ না করে মেজর মঞ্জুরকে ব্যবহার করলেন জেনারেল ওসমানী।

কিন্তু কিছু ভুল বুঝাবুঝিতে এই বদলের পরিণাম ভালো হয়নি। যশোরে পরাজিত পাকবাহিনী খুলনায় এসে প্রতিরোধ গড়ে তুললে মেজর মঞ্জুর তার বাহিনী নিয়ে খুলনা আসে এবং দুই সেক্টর মিলে শিরোমণির ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে পাকিস্তানিবাহিনীকে পরাজিত করে।

খুলনা জয়ের পর মেজর জলিল তার ৯নং সেক্টরের বাহিনী নিয়ে খুলনা শহীদ হাদিস পার্কের উত্তরে ইউনাইটেড ক্লাবে অবস্থান নেন।

মেজর মঞ্জুর খুলনা সার্কিট হাউসে আসেন। মেজর মঞ্জুর মেজর জলিলকে ডেকে পাঠান। সে সময় মেজর জলিল একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। ফলে, তিনি জানান, পরে আসবেন তিনি। এতে মেজর মঞ্জুরের অহংবোধে আঘাত লাগে। ক্ষিপ্ত মঞ্জুর মেজর জলিলকে হুমকি দিয়ে যান এর পরিণাম ভালো হবে না।

পরদিন মেজর জলিল খুলনা থেকে বরিশাল যান। ২ দিন পর বরিশাল থেকে খুলনা ফিরে এসে দেখেন তাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মেজর জয়নাল আবেদিনকে কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জলিল তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব না আসা পর্যন্ত চুপচাপ থাকবেন তারা।

এদিকে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানিদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র নিয়ে যেতে চাইলে জলিল বাধা দেন। তিনি বলেন, সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর মতামত না পাওয়া পর্যন্ত কোনো অস্ত্র কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। এ নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়।

কিছুক্ষণ পর মেজর মঞ্জুর ফোন করে জানান, জেনারেল ওসমানী সব সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে জরুরি মিটিং করবেন ঢাকায়। যশোর থেকে মেজর মঞ্জুরের জন্য একটা বিমান যাবে, মেজর জলিলও যেন এক সঙ্গে সেই বিমানে যায়। কিন্তু মেজর জলিল জানিয়ে দেন, সে তার সঙ্গীদের নিয়ে সড়ক পথে যাবে।

এবারো মেজর জলিলের এই সিদ্ধান্তে চরম অপমানিত হলেন মেজর মঞ্জুর। এরপর মেজর মঞ্জুর ও জেনারেল ওসমানীর কি কথা হয়েছিল সেটা জানা যায়নি। শুধু আমরা জানতে পারি মেজর জলিলসহ তার সঙ্গীদের রাস্তায় গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে আটক করে নিয়ে আসা হয়। এর পেছনে জেনারেল ওসমানী ও মেজর মঞ্জুরের ইগো বা অহংবোধই মূল কারণ নাকি অন্য কোনো বড় কারণ আছে সেটাও পরিষ্কার জানা যায়নি।

তবে দুঃখের বিষয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে একটা অভিযোগ ছিল লুটতরাজের। একজন সেক্টর কমান্ডারের বিরুদ্ধে আনা এ রকম অভিযোগ আমাদের জন্য সত্যি লজ্জার।

মেজর জলিলের ও তার সঙ্গীদের ব্যাগ ও ট্রাংক একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভাঙা হয়। কিন্তু আফসোস তাদের ব্যাগে কোনো টাকা পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার কিছুই ছিল না। মেজর জলিলের ব্যাগে পাওয়া গেল শুধু গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন বই! পরে ম্যাজিস্ট্রেট বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছিল এসব ব্যাগে লুট করা টাকা পয়সা ও সোনার অলংকার আছে! এরা খুলনা থেকে লুট করে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছিল!

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরলেন। মেজর জলিলকে ঢাকায় আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো। বাকি সঙ্গীদের ছেড়ে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর সামনে জেনারেল ওসমানী সব সেক্টর কমান্ডারদের নামের তালিকা জমা দিলেন। কিন্তু সে তালিকায় ৯নং সেক্টর কমান্ডারের নামের স্থানে ছিল মেজর জয়নাল আবেদিনের নাম।

একজন বীর সৈনিকের বীরত্ব, নিবেদনের কথা পুরোটা জানা হলো না বঙ্গবন্ধুর!

মেজর জলিল হয়ে রইলেন একমাত্র খেতাববিহীন সেক্টর কমান্ডার! স্বাধীন দেশের প্রথম রাজবন্দি হতে হলো পাকিস্তান বাহিনীর মেজর পদের চাকরিতে ফিরে না গিয়ে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা বীর সৈনিককে!

১৮ ডিসেম্বর বরিশালে মেজর জলিলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২১ ডিসেম্বর বরিশাল হেমায়েতউদ্দিন খেলার মাঠে এক বিশাল জনসভায় তিনি ভাষণ দেন। ওই দু'টি জনসভায় এত বেশি স্বতঃস্ফূর্ত জনতা উপস্থিত হয়েছিল- যা বরিশালবাসী আগে আর কখনো দেখেনি। স্বাধীনতার পর পর ভারত বাংলাদেশকে কার্যত একটি প্রদেশ হিসেবে আচরণ করার প্রয়াস পায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সম্পদ ও পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট করে ভারতে নিয়ে যেতে থাকে। যশোরে লুটের মাল বয়ে নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িবহরকে বাধা দেওয়ায় ৩১ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় মেজর জলিলকে বন্দি করা হয়। যশোর সেনানিবাস অফিস কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে তাকে আটকে রাখা হয়।

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি। পাঁচ মাস ছয় দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই মেজর জলিল মুক্তি লাভ করেন। সেক্টর কমান্ডারসহ কৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে নানা সম্মানসূচক উপাধি দেওয়া হলেও তাকে বঞ্চিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধপরবর্তী লুণ্ঠন এবং তৎকালীন মুজিব সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধাচরণই ছিল প্রধান কারণ।

'৭২-এর ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তিনি রাজনীতিতে নামেন। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উলেস্নখযোগ্য ও আলোচিত ঘটনা। পরবর্তীকালে তিনি এই দেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন।

১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশালের বাকেরগঞ্জ, উজিরপুরসহ পাঁচটি আসনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে তার বিজয় ছিল নিশ্চিত, কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে বিজয়ী হতে দেয়নি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এই দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন জাসদ। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি করলে জাসদের বহু নেতাকর্মী হতাহত হন। মেজর জলিল নিজেও আহত হন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও মেজর জলিল রেহাই পাননি। ১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। সামরিক ট্রাইবু্যনালে কর্নেল তাহের ও মেজর জলিলের ফাঁসি হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মেজর জলিলের মৃতু্যদন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়।

তখন প্রায় সাড়ে চার বছর কারাভোগের পর ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে তিনি টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা সায়মা আকতারকে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা সারাহ জলিল ও ফারাহ জলিল।

ক্রমান্বয়ে মেজর জলিলের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর তিনি জাসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি 'কৈফিয়ত ও কিছু কথা' নামক একটি গ্রন্থে লিখেছেন।

মেজর জলিল এমন কিছু গ্রন্থ লিখে গেছেন, যা আমাদের জাতীয় জীবনের যে কোনো সন্ধিক্ষণে দিকনির্দেশনার কাজ করবে। তার একটি গ্রন্থ 'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' দেশপ্রেমের এক বলিষ্ঠ এবং উচ্চকিত স্স্নোগানে রূপান্তরিত হয়েছে।

১৯৮৯ সালের ১১ নভেম্বর মেজর জলিল পাকিস্তান যান। ১৬ নভেম্বর রাজধানী ইসলামাবাদে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ২২ নভেম্বর তার লাশ ঢাকায় আনা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

উলেস্নখ্য, মেজর (অব.) জলিলই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যার লাশ দাফনের মাধ্যমেই মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন শুরু হয়েছে। মৃতু্যর সময় মেজর (অব.) এম এ জলিল মা, স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান রেখে গেছেন।

আজীবন সততার রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিলের ভূমিকার জন্য বর্তমান সরকারের উচিত মেজর জলিলকে বীর-উত্তম ভূষিত করা হোক।

বাংলাদেশের আজকের প্রেক্ষাপটে মেজর জলিল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এক সময় যে কোনো দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তর্জনি উঁচিয়ে 'খামোশ' বলতেন মওলানা ভাসানী। স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গের প্রেক্ষাপটে 'রুখো' বলে আধিপত্যবাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন মেজর জলিল।

'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' তার দেশপ্রেমের এক অমর গদ্যকাব্য। আজ বিনম্রচিত্তে পরম শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করছি। তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে নতুন প্রজন্ম জাগুক- এই প্রত্যাশা করছি।

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম :চেয়ারম্যান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে