বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হৃদ্যতা

নাহিদা আক্তার মিম
  ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হৃদ্যতা
শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হৃদ্যতা

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ও তার গুণগত মান একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি উন্নত ও শক্তিশালী বন্ধন জাতির উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এই সম্পর্ক শুধু শিক্ষা প্রক্রিয়াকে সহজতর করে না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও বড় প্রভাব ফেলে। শিক্ষার গুণগত মান, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক উন্নয়ন, জাতীয় উন্নয়নে এবং জাতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তিতে উপস্থাপন করতে এই সম্পর্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পিয়ার্সন ও হেইনের (২০০৬) একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষার প্রতি মনোযোগ বাড়ায়। অর্থাৎ ইতিবাচক সম্পর্ক শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তার শিখন ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। শিক্ষার্থী পাঠ প্রদানে অপারগ হলে শিক্ষক যদি তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, এতে তার মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন কি আত্মসম্মানহীনতা বা হীনমন্যতা অনুভব করে একপর্যায়ে শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝড়ে পড়ে। শাসনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। শিক্ষার্থীকে হতে হবে অনুগত, সম্মান প্রদানে সচেতন হতে হবে তার শিক্ষকের প্রতি। একইসঙ্গে শিক্ষককেও হতে হবে শিক্ষার্থীর প্রতি স্নেহশীল, সহযোগিতা করতে হবে তার শিক্ষা জীবনের সব ক্ষেত্রে, কারণ তিনি জাতি গঠনের কারিগর। একাডেমিক জার্নাল 'ঈযরষফ উবাবষড়ঢ়সবহঃ' এ প্রকাশিত গবেষণায় উলেস্নখ করা হয়েছে যে, 'শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্কুল ড্রপআউটের হার হ্রাস করে। শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়, যা জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক ভবিষ্যতে দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি করে, যা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।'

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত সব জাতির হাতিয়ার হলো তাদের শিক্ষা ও প্রযুক্তি। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত সচেতন। কারণ, তারা কোয়ান্টিটির পাশাপাশি কোয়ালিটিকেও গুরুত্ব দেয় অত্যধিক। তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে বাজেট বরাদ্দ এবং তা বৃদ্ধিতেই তারা সীমাবদ্ধ নয়। বরং তারা কোন ধরনের প্রোডাক্টিভ কার্যক্রম করলে তাদের জাতিগত উন্নয়ন হবে, সে বিষয়ে তারা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়াও ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বে মডেল হিসেবে দেখা হয় এবং এটি বিশ্বসেরা শিক্ষাব্যবস্থা বলে পরিচিত। কারণ, তাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শিক্ষার মান বৃদ্ধির মূল কারণ।

তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। এখানে দেশের সব স্থানে যেমন শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বা শিক্ষাব্যবস্থা সমান নয়, তেমনি শিক্ষার মানও সমান নয়। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা আবার রয়েছে শিক্ষক নির্বাচনে স্বচ্ছতার অভাব। নতুন শিক্ষা কারিকুলামের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশিত হয় নতুনভাবে। যেখানে শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের ও অভিভাবকদের রয়েছে নানান অভিযোগ। শিক্ষক নিজে পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোননির্ভর করে তুলছেন বলে এমন অনেক অভিযোগ উঠেছে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। যা প্রকাশিত হওয়ার পর পরবর্তীতে সেই শিক্ষকের নানান তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। এমনকি পরীক্ষার ফলাফলেও এর প্রভাব পড়েছে বলে জানা যায়। এভাবে এক ভারসাম্যহীন অবস্থার জন্য শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। তবে বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে স্কুলগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নত হলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিতি ও পরীক্ষার ফলাফলে উলেস্নখযোগ্য উন্নতি ঘটে। যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ওঊজ) ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ভালো সম্পর্কের স্কুলগুলোতে পাসের হার ১৫-২০% বেশি। অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হলে তা শিক্ষার মান, ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং জাতীয় উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সুতরাং, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে, সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সহায়ক। দেশি-বিদেশি গবেষণাগুলো বারবার এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, শিক্ষার্থীদের উন্নতির পেছনে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। জাতি হিসেবে উন্নত হতে হলে উন্নত চিন্তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই পারে সেই ব্যবস্থা এবং পরিবেশ তৈরি করে দিতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হলো পিতামাতার অবর্তমানে শিক্ষার্থীদের অন্যতম অভিভাবক।

নাহিদা আক্তার মিম

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে