বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

মেধা পাচার রোধ করুন নইলে দেশ মেধাশূন্য হবে

পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও উচিত আত্মচিন্তায় মগ্ন না থেকে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায়, মেধা পাচার রোধ করা আদৌ সম্ভব নয়।
মো. সবুজ মিয়া
  ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মেধা পাচার রোধ করুন নইলে দেশ মেধাশূন্য হবে

উচ্চশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ স্তর। প্রতিনিয়ত উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে বাংলাদেশ থেকে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায়। যাদের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে দেশে ফিরে না এসে, সে দেশে স্থায়ী হয়ে যায়। বিষয়টি বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য শঙ্কার। মেধাবীদের দেশ ত্যাগ একটি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে পারে।

যদিও ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞান অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেছেন 'জ্ঞান অন্বেষণের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও'। চীন শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়ছে। মূলত জ্ঞান অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে উক্তিটি করা হয়েছে। প্রতি বছর উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে দেশ ত্যাগের বিষয়টি পূর্বে গাণিতিক হারে বাড়লেও বর্তমানে তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রবণতা অনেকাংশে বেশি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, দরিদ্রতা, কর্মসংস্থান সংকট, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, স্বৈর শাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশের অভাব প্রভৃতি কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তাছাড়া, দেশে মেধার যথাযর্থ মূল্যায়ন না হওয়া, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ার অজুহাতে প্রতিনিয়ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশ ছাড়ছে।

প্রতি বছর প্রায় অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করছে। যাদের মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ দেশে ফিরে আসে না। সে দেশের নাগরিত্ব গ্রহণ করে। এতে দেশে মেধা শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ- আমেরিকা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো। এসব দেশ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, উন্নত জীবনযাত্রা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মেধার ভিত্তিতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত স্কলারশিপ প্রদান করে থাকে। এভাবে প্রতি বছর উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী উন্নত জীবনের মোহে আকৃষ্ট হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।

এক সময় দাস ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তখন মানুষ-মানুষের দাস হিসেবে গণ্য হতো। ইউরোপীয় বণিকরা এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ করে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পাচার করত। দাস ব্যবস্থার শেষের দিকে ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সারাবিশ্বে কলোনি গড়ে তুলে। নিজের অধীনে থাকা কলোনিগুলো থেকে স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল আমদানি পরবর্তী সময়ে সে দেশেই উচ্চমূল্যে রপ্তানি শুরু করে। পাশাপাশি সম্রাজ্যবাদী শক্তি কলোনিগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাঁচার করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে শোষণ করে আজকের আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকার ভিত্তি স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একে একে সবগুলো কলোনি স্বাধীনতা লাভ করে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশবিদ্যায় জয় যাত্রা শুরু হয়। এর পেছনে মেধার ভূমিকা অনস্বীকার্য। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য ফাঁদ পেতে রাখে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা উন্নত জীবনের মোহে পড়ে সেই ফাঁদে পা দেয়। এভাবে প্রতিনিয়ত তৃতীয় বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বে মেধা পাচার হচ্ছে।

অথচ একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে তৈরি করতে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বই, উপবৃত্তি, ভুর্তুকি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র মূল্যে অধ্যায়নের সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ প্রভৃতি খাতে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করে থাকে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলাই এর মূল লক্ষ্য। যারা পরবর্তী সময়ে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।

কিন্তু তারা কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরের মাথার ঘাম পায়ে পড়া অর্থে বিদ্যার্জন করে দেশের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতো নিজের উজ্জ্বল ভবিষতের আশায় ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলস্বরুপ দেশে মেধার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। মেধাবীদের দেশত্যাগ একটি দেশকে মেরুদন্ডহীন বানিয়ে দিতে পারে। আজকের অফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহারণ। মহাদেশটিতে বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদের প্রাচুর্যতা থাকলেও শিক্ষিত- দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে তা কাজে লাগাতে পারছে না। বিপরীতে ইউরোপ আমেরিকায় প্রকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্ব থেকে মেধা পাচার করে জ্ঞান বিজ্ঞানের শীর্ষে আরোহণ করছে। আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগলের মতো টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের মেধাবীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যদিও এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। সর্বোপরি পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মেধাবীরা একটি রাষ্ট্রের প্রাণভ্রমরা। বর্তমান বিশ্ব মেধার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বলা হয় যে, 'একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে চাইলে, আগে ওই দেশের মেধাবী-বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করে দাও।' ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর নিজেদের নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের মেধাবীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া। যদিও তখন উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান- জ্যামিতিক হারে মেধাবীদের দেশ ত্যাগের ঢল রুখতে না পারলে ১৪ ডিসেম্বরের নীল নকশা বাস্তবায়ন হতে বেশি দিন লাগবে না। মেধা পাচার বন্ধ করুন নইলে দেশ অচিরেই পঙ্গু হবে।

মেধা পাচার রোধ করতে চাইলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন মেধার যথাযর্থ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা। কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সরকারের উচিত দেশের সর্বত্র আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলা। সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি খাতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্রযুক্তি খাতকে ঢেলে সাজাতে পারলে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমের গণতন্ত্রায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি সমস্যাগুলো হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও উচিত আত্মচিন্তায় মগ্ন না থেকে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায়, মেধা পাচার রোধ করা আদৌ সম্ভব নয়।

মো. সবুজ মিয়া :নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে