আমরা মাত্র ১০০ দিন আগে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছিলাম। এটি ছিল ছাত্র-জনতার একটি বিপস্নব, যা গত ১৬ বছর ধরে শাসন করা এক ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। এজন্য ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী, শ্রমিক এবং সাধারণ প্রতিবাদকারীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার ছাত্র-জনতা। আমরা তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি, যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা চিরদিনের জন্য তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, দৃষ্টিশক্তি এবং শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন এবং যারা এখনো জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এখন যখন ঢাকা এবং অন্য শহরের রাস্তায় হাঁটি, তখন রাস্তাগুলোর দেওয়ালে তরুণদের আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আঁকা রঙিন চিত্রকর্মগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। এই চিত্রকর্মগুলো দেখলে যে কেউ তরুণদের সৃজনশীলতার শক্তিতে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। এখানে কোনো ডিজাইনার ছিল না, কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছিল না এবং কেউ এর জন্য তহবিল দেয়নি। দেশের লাখ লাখ মানুষ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ। স্বৈরাচারের বাংলাদেশি আইকন দেশ ছেড়েছেন সেই গত ৫ আগস্ট অভু্যত্থানের উত্তাল দুপুরে। তবু পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি সমাজে। রাষ্ট্রীয় জীবনের আত্মবিশ্বাসও ফেরেনি। তা না হলে দৃশ্যত দিলিস্ন থেকে ফ্যাসিবাদী 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র 'ফাঁস' করা টেলিফোন কথোপকথনের হুমকিতে সারা দেশ কাঁপে কী করে? প্রশাসন তটস্থ, জনগণ অস্থির হয়ে পড়ে কেন? দেশের মানুষ আওয়ামী আমলের গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে কতটা মুক্তি পেল এবং অতঃপর তারা বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক সুযোগ পাওয়ার সুযোগ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছে কি না, সে মূল্যায়নের সময় কিন্তু এসে গেছে। প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে যা চলছিল, তা স্থিতিশীলতা নয়, ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতিতে গড়া অপশাসনের শৃঙ্খল। ওই ব্যবস্থার প্রতি নূ্যনতম গণ-আস্থা থাকলে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে তা খান খান হয়ে যেত না। মেয়াদ স্বল্প বা দীর্ঘ যা-ই হোক, বিপস্নবের আগে-পরের দুই সরকার ও শাসকদের পারফরম্যান্সের তুলনা করা যেতেই পারে। গণবিরোধী ও দেশবিরোধী কর্মকান্ড, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার, হত্যা ও গুম, জুলুমশাহি, গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, ভোট চুরি, রাজনৈতিক সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থান নষ্ট- এসব কাজ কোন আমলে সংঘটিত হয়েছে? মানুষের ধারণা ও বোঝাপড়া, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ও ন্যায়পরায়ণতার সূচক দিয়ে যে কেউ এটা বিশ্লেষণ করতে পারেন। হাসিনা এখন অতীত। তার শাসনামলে হারিয়ে যাওয়া গণমানুষের আস্থা ও আশাবাদ ফেরানোর প্রতিশ্রম্নতি নিয়েই ক্ষমতার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। মানুষের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রক্ত ঝরার বেদনা বিপস্নবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এই অভাবনীয় ঘটনার ফলে জনমনের প্রাথমিক স্বস্তি ইউনূস সরকারের জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান, কৃতিত্ব নয়। একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে। এই সরকার কয়েকটি কমিশন গঠন, একঝাঁক নিয়োগ এবং ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করাসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এক দশকের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে জুলাই-আগস্ট বিপস্নবের মধ্য দিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ সরকার ক্ষমতা সুসংহত করতে পেরেছে, এমনটা মনে হয় না। আমলাতন্ত্র ও বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা তার নজির। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সেবাপ্রাপ্তিতে দুর্নীতির উপস্থিতি এবং আওয়ামী আমলে অর্জিত অবৈধ অর্থসম্পদ উদ্ধারে ব্যবস্থা না নেওয়া, চলমান শাসনের বিচু্যতিই প্রমাণ করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যেমন খুব আস্থাশীল হওয়া মুশকিল, তেমনি উন্নতি দেখা যায় না ব্যবসায়িক পরিবেশেও যেখানে উদ্যোক্তা ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ হতে পারতেন ইতোমধ্যে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ করা অন্তর্র্বর্তী সরকারের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ।
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকারের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার আনার অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক ঝুটঝামেলাও আছে। সংস্কার কর্মসূচির দিকে নজর দিতে চাইলে ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। বিভক্তির জায়গাগুলোয়ও নজর দিতে হবে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূস নিয়মিত বৈঠক করছেন। যদি রাজনৈতিক পক্ষগুলো সংস্কারপ্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তবে এ মুহূর্তে সবকিছুই সম্ভব। যদিও এটি একটি বড় প্রশ্ন। তাদের সবার সংস্কারের প্রতি আগ্রহ আছে বলে বিশ্বাস করি না। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। তারা সংস্কারের জন্য ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীদের সময় দিতে চায়। দলীয় নেতাদের প্রতিশোধমূলক সহিংসতা থেকে বিরত রাখতে এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত সদস্যদের বহিষ্কারের মতো প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন বিএনপির নেতারা। বিএনপির মধ্যে জনগণের আস্থার ঘাটতি আছে এবং তাদের জনগণের আস্থা ফিরে পেতে হবে। সর্বোপরি, তা দেশের জন্য ভালো হবে। তবে ড. ইউনূসকে বিএনপি কতটা সময় দিতে চায়, তাও স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকদের সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তাদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচার চালাতে আগ্রহী। বিএনপির নেতৃত্ব যদি ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, তখন দলটি দ্রম্নত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করতে পারে। যে নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা আছে। নিজেদের দাবি পূরণের স্বার্থে দলটি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি অন্তর্র্বর্তী সরকারকে নজরদারিতে রাখার কাজ করছে। তবে তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের কথা মাথায় রেখে দলটি ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ, দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ইতোমধ্যে তরুণ প্রজন্মের মোহ ভেঙে যাচ্ছে। পাছে তারা বিএনপি থেকেও মুখ ঘুরিয়ে না নেয়, সে কথা মাথায় রেখেছে দলটি। বিএনপিকে ঠেকাতে পারে অন্তর্র্বর্তী সরকারের দুই প্রধান সমর্থক শিক্ষার্থী ও সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তিনি তার ক্ষমতা দেখান না, তবে কোনো না কোনোভাবে তিনিই এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছেন। জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভের পর বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রদের উত্থান হয়। যদিও ছাত্ররা এখনো কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। তাদের আগ্রহের জায়গা অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ঘিরেই। এ ক্ষেত্রে তারা চায় অন্তর্র্বর্তী সরকার বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকুক এবং বড় ধরনের সংস্কার আনুক। তাই বলে ছাত্রদের এক পাশে সরিয়ে রাখাটা যে সহজ কাজ হবে, তা নয়। সাংবিধানিক সংস্কার, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ এবং নৃশংসতার ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সদস্য এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমাগত সামনে আসছে। ছাত্রনেতারাও রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান বলে মনে করা হয়। যদিও রাজনৈতিক দল গঠন করতে সময় লাগবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এতটাই নোংরা যে শিক্ষার্থীরা এখন খেলায় নামলে তারাও অন্য দলগুলোর মতো হয়ে যাবেন। ফলপ্রসূ সংস্কারের পর শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। আর এটা আগামী নির্বাচনের পর হতে পারে। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি পস্ন্যাটফর্ম করেছে। এ পস্ন্যাটফর্মটি সংস্কারের পক্ষে তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন তৈরি করতে চায়। ইসলামপন্থি পক্ষগুলোকে মাঠের বাইরে ঠেলে দিয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে তোলার চেয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করাটা জরুরি। সংস্কারের দাবি ছাড়া শিক্ষার্থীরা কোনো মতাদর্শিক জায়গা থেকে সংঘবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি, তার একটি সেনাবাহিনী। গত ৪ আগস্ট হাসিনার দেওয়া কারফিউ কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। আর তাতে হাসিনার পরিণতি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এরপর অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের আলোচনায় সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনাপ্রধান কিংবা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়নি। সেনাপ্রধান বলেছেন, যাই হোক না কেন, তিনি ড. ইউনূসের পাশে থাকবেন। যেন তিনি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। তবু সেনাবাহিনীর সমর্থন ধরে রাখতে গেলে অতীতে সেনা কর্মকর্তা কিংবা জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা দুর্নীতির অভিযোগের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও সদিচ্ছায় সীমাবদ্ধতা তৈরি হবে। অথচ জনমত এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে। ওয়াকারও সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে নিজস্ব ধারণা হাজির করেছেন। সশস্ত্র বাহিনীকে প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন না রেখে প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণে রাখার সুপারিশ করেছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থিদের বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের প্রভাব বেড়েছে। নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ নেতা হিসেবে উপস্থাপনকারী শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দলটিকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তার কঠোর পদক্ষেপ সত্ত্বেও ইসলামপন্থি দলগুলো আরও শক্তিশালী হয়েছে। শেখ হাসিনা পলায়নের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা নিজেরাই পূরণের জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন তারা। একটা সময় ছিল যখন '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশিদের অনেকে জামায়াতকে ঘৃণা করত। কিন্তু এখন শেখ হাসিনা প্রশাসনের নিপীড়নের ভুক্তভোগী হিসেবে সহানুভূতি পাচ্ছে তারা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইসলামপন্থি পক্ষগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জুলাইয়ের শেষের দিকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ও অন্য ইসলামি দলের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। আন্দোলনে অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করেছে। দলটি তাদের নিবন্ধন ফিরে পেতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে। ড. ইউনূসকে অবশ্যই দলটিকে বিবেচনায় রাখতে হবে। ইতোমধ্যে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে ড. ইউনূসকে আপসও করতে দেখা গেছে। ইসলামপন্থিদের প্রভাব বাড়তে থাকায় ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী অনেকে বিচলিত বোধ করছেন। দেশের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে ইসলামপন্থি দলগুলোকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করাটা হিতে বিপরীত হতে পারে। ইসলামপন্থি পক্ষগুলোকে মাঠের বাইরে ঠেলে দিয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে তোলার চেয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করাটা জরুরি।
আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রত্যেকেই তাদের মতপ্রকাশ করতে পারবে এবং বৈধ ও শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে পারবে যদি তারা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে মেনে নেয়। জামায়াতে ইসলামী ও অন্য ইসলামি দল একটি জোট গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করছে। তবে রাস্তাঘাটে সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেলেও নির্বাচনের মাঠে তাদের বড় হুমকি মনে করা হয় না। তারা কখনো নির্বাচনে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের প্রশ্নে তারা বড় দলগুলোর কাছে নিজেদের অপরিহার্য বলে প্রমাণ করতে পেরেছে। গণ-অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। যদি জনসমর্থন ধরে রাখতে না পারে, তাহলে এই সরকারকে হয়তো একটি আগাম নির্বাচন দিতে হবে। আর এটা হলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে বিএনপি। তবে ক্ষমতায় গেলে দলটিকে হতে হবে সংযত। যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে বাংলাদেশ আবারও লেজুড়বৃত্তি, পেশিশক্তি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেচ্ছ ব্যবহারের রাজনীতিতে ফিরে যাবে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে দেশটির ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা। পাশাপাশি রাষ্ট্রসংস্কারের বিরল যে সুযোগ এসেছে, তাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, যদি বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অরাজকতায় রূপ নেয়। এ ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী হয়তো ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসবে। এতে দেশটিতে আবার সামরিক শাসন শুরু হতে পারে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষের উচিত, এ রকম কিছু একটা যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সজাগ থাকা। দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে। এজন্য ধীরগতিতে হলেও সরকার যে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পেরেছে, তা দেখাতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসার মতো বিষয়গুলোয় এই সরকার অবশ্য ইতোমধ্যে কিছু সাফল্য দেখিয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত সামনে আসছে। এরপরও বর্তমানে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাই অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায়। আসছে বছরগুলোয় এই আকাঙ্ক্ষা কীভাবে ধরে রাখা যায়, সেটা চিহ্নিত করতে হবে ইউনূস সরকারকে। পাশাপাশি সংস্কার কাজে ধীরে ধীরে গতি আনতে হবে। একটি নির্বাচন আয়োজনের পথও তৈরি করতে হবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অন্তর্র্বর্তী সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। এর মধ্যে একটি হতে পারে রাষ্ট্রীয় সেবাদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে গেঁড়ে বসা দুর্নীতি মোকাবিলা। সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার কীভাবে করা হবে, অন্তর্র্বর্তী সরকারকে এ বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সেটা সাম্প্র্রতিক আন্দোলনের সময়ে হওয়া মামলা ও শেখ হাসিনার শাসনামলে পুরনো মামলা- উভয় ক্ষেত্রে করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিচারব্যবস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করলে সেটা হবে সবচেয়ে উত্তম পন্থা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে অতীত যে অভিজ্ঞতা, সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে এসব মামলার বিচার করতে হলে ১৯৭৩ সালের যে আইনে এই ট্রাইবু্যনালের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, সেই আইনে সংস্কার আনতে হবে। এই ট্রাইবু্যনালে অন্তত একজন আন্তর্জাতিক বিচারক রাখতে হবে। অন্যদিকে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জাতিসংঘের সমর্থন অব্যাহত রাখা উচিত। অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকারে সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল এমন অভিযোগে অনেককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিশোধপরায়ণ এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হয়েছে, সেটা সবার কাছেই বোধগম্য। কিন্তু এতে যেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, যা অন্তর্র্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। আর এসব পদে নতুন করে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের কারণেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা চালুর বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে, অনিয়মে ভরা বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এটা করা হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর চেয়েও বেশি কিছু। ড. ইউনূস নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিটির মধ্যে পাঁচটিরই কাজ হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনবিষয়ক।
বাংলাদেশে নির্বাচনের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে ভবিষ্যতে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে তার বিস্তৃত রাজনৈতিক সংস্কারের নীতি সফলভাবে এগিয়ে নিতে হবে। কাজেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এমন একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আছে। সেই সঙ্গে তাদের নির্দলীয় ব্যক্তি হতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক