ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন আগামী জানুয়ারিতে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা ঠিক বলা যাচ্ছে না। এটা বুঝতে হলে প্রধান কিছু ফ্যাক্টরের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মূলত ট্রাম্প প্রশাসন কূটনীতিতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র চর্চা, জলবায়ু পরিবর্তন, অন্য দেশে আর্থিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে জোর না দিয়ে বেশি জোর দেবে আমেরিকার অর্থনীতি, ফার্স্ট আমেরিকা নীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, অবৈধ অভিবাসন রোধ, আমদানি দ্রব্যে শুল্ক আরোপ ইত্যাদিতে। ট্রাম্পের এসব নীতি গ্রহণ করলে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। তবে ধারণা করা হচ্ছে ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি গ্রহণের কারণে আমেরিকা-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ডেমোক্র্যাট নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। ক্লিনটন পরিবারে সঙ্গে তার বন্ধুতপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তাই কেউ কেউ মনে করছেন ট্রাম্প হয়তো ইউনূস সরকারের জন্য খুব একটা ভালো হবে না। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দু'দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় থাকবে। বাংলাদেশ-আমেরিকা কূটনৈতিক সম্পর্কে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
নির্বাচনের আগে ট্রাম্প তার এক্স একাউন্ট থেকে বাংলাদেশের হিন্দু মাইনরিটি নিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন তা মূলত হিন্দু ভোটারদের ভোট পাওয়ার জন্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমেরিকার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত ও চাঙা করতে মূলত বেশি জোর দেবে ট্রাম্প। কেননা, বর্তমান আমেরিকার অর্থনীতি খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। সাম্প্রতিক একটা জরিপে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন তারা গত চার বছর আগের তুলনায় বর্তমানে খারাপ অবস্থায় আছেন। ৪ শতাংশ বেকারত্ব, গৃহহীন মানুষ, বাসা ভাড়া বেশিসহ আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। যার কারণে তারা ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছেন তাদের অর্থনৈতিক দিকটি যেন জোর দেওয়া হয়। আবার ব্যবসায়ীদের কাছেও ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। ট্রাম্প বলেছেন, ব্যবসায়ীদের ট্যাক্স কমিয়ে আনা হবে- যাতে বেশি ব্যবসা হয় ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।
অন্যদিকে, চীন একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পুরো বিশ্বব্যাপী চীন তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে- যা ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকে মানতে পারেনি। যার ফলে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চীন-আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ লক্ষ্য করা যায়। আমি মনে হয় ট্রাম্প চীনের ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, শুল্ক আরোপ করতে পারে। ফলে, দেখা যাবে চীনের রেডিমেড গার্মেন্টসের বিপরীতে দ্বিতীয় সর্বোত্তম মার্কেট হিসেবে আমেরিকা বাংলাদেশকে বেছে নিতে পারে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশ আসে আমেরিকা থেকে। এই পার্সেন্টেজ আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ওপর অতিরিক্ত কোনো শুল্ক আরোপ বা বিধি-নিষেধ মোকাবিলায় কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কে আরও জোর দেবে ট্রাম্প। কেননা, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বিস্তার ঠেকাতে ভারতকে তার দরকার যেহেতু চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বন্ধুতপূর্ণ সম্পর্কের কথা জানা গেলেও ট্রাম্প কূটনৈতিক সম্পর্কে তার নিজ দেশের স্বার্থ আগে দেখবে। অনেকে বলছেন, মোদি ট্রাম্পের কাছে শেখ হাসিনার জন্য তোষামোদ করতে পারে, কিন্তু আমি মনে করছি, ট্রাম্প বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে তেমন কোনো চাপ তৈরি করবে না। বড় বড় অনেক বিষয় আছে যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ, চীন, ন্যাটো এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ট্রাম্প প্রশাসন। ওয়াশিংটনের ঢাকার প্রতি কম ফোকাস একটা বড় সুযোগ আমাদের জন্য। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে পারে। চীনের টেকনোলজিক্যাল বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি জোর দিলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। বাংলাদেশের পানি সমস্যা সমাধানে চীনের বিনিয়োগ জোরদার করা যেতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের প্রতি ট্রাম্পের পলিটিক্যাল কোনো ফোকাস না থাকলেও জিওপলিটিক্যালি গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে চীন ও আমেরিকার সঙ্গে। বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করতে হবে আমেরিকার বিনিয়োগের জন্য।
ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসন সমস্যা সমাধানে বেশি জোর দেবে যেটা তিনি আগেও করছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অভিবাসী আছে যারা লিগ্যাল ডকুমেন্ট ছাড়া বসবাস করছে। বাংলাদেশ ও এর ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং, বাংলাদেশি যে অবৈধ অভিবাসীরা আছে তাদের জন্য ট্রাম্প একটা উদ্বেগের কারণ। তার অভিবাসন নীতির কারণে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স আয়ে বড় প্রভাব পড়তে পারে।
ট্রাম্প মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সহায়তার দিক থেকে সরে আসতে পারে। ট্রাম্প মূলত আমেরিকা ফার্স্ট নীতিতে জোর দেবে। অন্য দেশের প্রতি আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দেবে। ফলে, বাংলাদেশ বৈদেশিক সহায়তার যে বড় একটা অ্যামাউন্ট পেয়ে আসছিল আমেরিকা থেকে তা আর পাবে না বা কম পাবে। ফলে, রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা পেত সেটা না পাওয়ায় একটা চাপ পড়বে বাংলাদেশের ওপর। রোহিঙ্গাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সমস্যা দেখা দেবে। আবার আমেরিকা জাতিসংঘে বড় একটা অ্যামাউন্টও দিয়ে সহয়তা করে। যেমন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ২৮ শতাংশ সহায়তা দেয়- যা কমিয়ে দেবে। আবার দেখা যায়, এই শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অনেক বড়। ফলে যারা শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করছে তাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন তেমন পদক্ষেপ নেবে না। প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট থেকে বের হওয়া ট্রাম্প প্রশাসন পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। জলাবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিছুটান বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।
তবে সময়ই বলে দেবে আমেরিকা-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোন কোন ধরনের পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন বাংলাদেশের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যকে ভালো করতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়োপযোগী 'বৈদেশিক নীতি' গ্রহণ করতে হবে।
আলিফা আক্তার রেশমী : নবীন লেখক