বৈষম্যহীন মানবিক বাংলাদেশই প্রত্যাশিত
শোষণ, বঞ্চনা, মূল্যবোধের নিম্নযাত্রার জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য যে অনেকাংশে দায়ী এ কথাটি প্রমাণ করার জন্য প্রথাগত গবেষণা করার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার মানুষকে যেমন দ্রম্নত সাম্প্রদায়িক করে তোলা যায় একইভাবে নানা অর্জনের জন্য ক্ষ্যাপা ষাঁড় হয়ে অনৈতিক কাজের দিকে ঠেলে দেওয়াও যায় খুব সহজে।
প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেখর ভট্টাচার্য
আকাশের রঙের মতো বাঙালির মন, ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টায়। বাঙালি মনস্তত্ত্বের স্বরূপ অন্বেষণ করা পৃথিবীর দুরূহতম কাজগুলোর অন্যতম। বড় ইন-কনসিস্টেন্ট, অধারাবাহিক। এ কারণে বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ নিয়ে শেষ কথা বলার চেষ্টা করা অনুচিত। নীরদ সি চৌধুরী, বাঙালির নিষ্ঠুর সমালোচক, বাঙালিকে তিনি আত্মঘাতী হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারও আবার নানা কারণ রয়েছে, তিনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের আনকূল্য পেতে মরিয়া ছিলেন। তার মনোজগৎ ছিল ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উপাদান দিয়ে ঘেরা।
তবে অধিকাংশ বাঙালি মনীষীর বার্তা বাঙালি মানসের স্বরূপ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা প্রদান করে। জসিম উদ্দীনের 'নকশী কাঁথার মাঠে'র- নবম পর্বে এমন একটি বার্তা আমরা শুনতে পাই- যা পৃথিবীর সভ্যতম দেশের কোনো দার্শনিক কিংবা কবিকে উচ্চারণ করতে শুনিনি। বার্তাটি গাজীর গান থেকে তিনি উদ্ধৃত করেছেন, 'নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভর মিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।' ইউরোপ, আমেরিকার যেসব দেশে বর্ণ বৈষম্য সমাজকে আতঙ্কিত করে রাখে সে সব দেশেও এ রকম বার্তা কোনো লোক কবি কিংবা মূল ধারার কবির কবিতায় নির্দ্বিধায় উচ্চারিত হতে শুনিনি, অন্তত আমার জানা নেই। জাত পাত, মানুষে মানুষে বৈষম্য নিয়ে বাঙালি মনীষীদের বার্তা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। লালন যখন জাতি, সমাজে বৈষম্য দ্যাখে উচ্চারণ করেন : '...জগৎ জুড়ে জাতের কথা/লোকে গল্প করে যথাতথা।/লালন বলে জাতের ফাতা/ডুবাইছি সাধবাজারে' অনৈক্য, বিভাজনের বিরুদ্ধে এ রকম সরাসরি উচ্চারণ আমরা কী সমসাময়িক কালে শুনতে পাই? সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সেই অমর কবিতা আমরা শৈশবে পাঠ করেছি। একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি কত উদার, বিশ্বজনীন হলে আমরা মানবতার বাণীকে কবিতায় এ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন: 'জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে/ সে জাতির নাম মানব জাতি/এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত/একই রবি শশীর মোদের সাথী।'
বাঙালি মরমি সাধকদের সৃষ্টিকর্ম এবং যাপিত জীবন পাঠ করে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাওয়া যায়। ভোগ বিলাস, ক্ষমতা, ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে দূরে থেকে আমাদের উচ্চ জীবন দর্শন দিয়ে গেছেন তারা। কারা তারা? লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের পাশাপাশি, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, সৈয়দ শাহনুর, শাহ আছদ আলী পীরসহ আরও অনেক গুণীজন।
ত্যাগ যাদের জীবনের আদর্শ, মানুষকে ভালোবেসে যারা ঈশ্বর সান্নিধ্য পেতে চান, ভোগ বিলাস যাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ সেসব মানুষের দেশে আমরা কী করে ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, সম্পদের জন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে ক্রমাগত লিপ্ত থাকি? বিভেদ, অনৈক্য, প্রতিহিংসা আমাদের গিলে খেতে উদ্ধত হচ্ছে। আমরা কী ক্রমাগত গহিন জলে ডুবে যাব। এ প্রশ্ন যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের মনে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। তবে বাঙালি সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের অন্তহীন বিশ্বাস আছে। তারা লড়াকু। তারা বারে বারে ডাক দিয়ে যান। সৈয়দ হকের কবিতার পঙ্ক্তি আমাদের সাহস জোগায়: '... নূরলদীনের কথা' সারাদেশে পাহাড়ি নদীর মতো নেমে আসে সমস্ত ভাষায়/অভাগা মানুষ যেন আবার জেগে ওঠে এই আশায় যে- /আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়/আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায় দিবে ডাকু/জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।'
আমাদের এই বাংলাদেশে উদার, অসাম্প্র্রদায়িক, মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মনীষীদের দর্শনের কোনো অভাব নেই। ইউরোপ, আমেরিকাতে এ রকম উচ্চ মানবিক দর্শন যে খুব বেশি নেই সেটি বিশ্ব সাহিত্য এবং দর্শনে ঘুরা ফেরা করলে আঁচ করা যায়। আবাহ্মান বাংলার সাধু, গুরু, ফকির বাউলদের রচনা ও গানে মূলত মানুষেরই জয় গান গাওয়া হয়েছে। মানবতাকে ধর্ম বর্ণ জাত পাতের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। এ সব গানে এক ধরনের আধ্যাত্মিক গুরুবাদী তত্ত্বের আহ্বানের লক্ষ্য দেখা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ফকির লালানের গানের ভেতর এমন এক ধরনের অমিয় জাদু ভাব রূপ রস ছন্দ আবেদন সরলতা মধু প্রেম চেতনরস রয়ে গেছে- যা আমাদের এই কথিত মানব সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভাবুক চিন্তাশীল এবং সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে জাতি ধর্ম বর্ণ ছোট বড় নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষকে একটা আলাদা মানবিক চিন্তাচেতনা আর মানুষ ভজার জগতে নিয়ে যায়। লালনের গানের মধ্যে তত্ত্ব কথা ভাব কথা চরমভাবে বিদিত এবং প্রকাশিত। তার গানে সাম্য শান্তি ও মানব মুক্তির কথা আমরা শুনতে পাই।
হাসন রাজা। বিশ্বনাথ থানার রামপাশা গ্রাম থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যার জমিদারি। লাখ লাখ একর জমি ছিল পৈত্রিক জমিদারিতে। জীবনের একপর্যায়ে এসে মনে হলো সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে নিজেকে নিবেদিত করবেন। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে, সৃষ্টিকর্তার জন্য 'দেওয়ানা' না হলে স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকে ভালোবাসার মধ্যে পাওয়া যায় না। এই বোধোদয় তাকে মরমি সাধকে রূপান্তরিত করে। জীবন তার কাছে শূন্যের ওপর ভেসে থাকা। মহাজীবনের সন্ধানে ব্যাপ্ত হতে জাগতিক সব সম্পদ ভাগ করে দিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। এত ত্যাগ, এত নিবেদন তাকে এক অনন্য দার্শনিকে পরিণত করল। লোভ, লালসা, জীবনের সংকীর্ণতা ত্যাগ করে তিনি এক মরমি কবিতে রূপান্তরিত হলেন। 'সোনা বন্ধে' তার কাছে এক অসীম রহস্যের বিষয়, তার প্রেমে আকুল হলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তিনি নিজেই গেয়ে উঠলেন, 'সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো/সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল।/আরে না জানি কি মন্ত্র করি জাদু করিল' লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে যেমন গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল একইভাবে হাসন রাজার মরমি গান রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ যে ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত হিউবার্ট লেকচারে হাসন রাজার নাম উলেস্নখ করে বলেছিলেন, 'ওঃ রং ধ ারষষধমব ঢ়ড়বঃ ড়ভ ঊধংঃ ইবহমধষ যিড় ঢ়ৎবধপযবং রহ ধ ংড়হম :যব ঢ়যরষড়ংঢ়যরপধষ ফড়পঃৎরহব :যধঃ ঁহরাবৎংব যধং রঃং ৎবধষরঃু রহ রঃং ৎবষধঃরড়হ :ড় :যব ঢ়বৎংড়হ.' তারপর থেকেই হাসান রাজা সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজের আগ্রহ জন্মায়।
যে দেশের সুবর্ণ, কোমল ভূমিতে জন্ম নিয়েছেন ত্যাগী সাধক কবি, পীর ফকির সন্যাসী যারা জীবনের গান গেয়ে গেছেন ক্রমাগত সে দেশে মানুষের মধ্যে কেন এত অনৈক্য, এত বিভাজন। সম্পদ, ক্ষমতা, লোভ, লালসা আমাদের সমাজের মূল্যবোধকে অবিরাম অধঃপতিত করছে। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পরও উদার, গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ গড়তে আমাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। অথচ আমাদের প্রান্তিক মানুষ এসব হানাহানি, নিজেদের মধ্যে বিভেদ, প্রতিহিংসা পরায়ণতার সঙ্গে মোটেই যুক্ত নন। হেমন্তের মাঠে সোনালি ধানের দোলা দেখে আমরা যারা মুগ্ধ হই, যাদের অহোরাত্র শ্রমের বিনিময়ে এখনো আমাদের বাজারে চাল, ডাল, মাছ, সবজির বাজার টুই টুম্বুর তাদের জীবন ধারা কিন্তু সহজ, সরল এবং দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ। আমরা তাদের ফলানো ফসল স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়ে এসে প্রতি ধাপে মূল্যবৃদ্ধি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া করে ফেলি। আমাদের প্রান্তিক মানুষের জীবন ধারা, জীবন দর্শনে অপ্রয়োজনীয় বাকবিতন্ডা থেকে নিরলস কর্ম অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। অর্থ, সম্পদ ক্ষমতা লোভী মানুষ প্রান্তিক মানুষকে ক্রমাগত প্রান্তে ঠেলে দিয়ে শোষণ, শাসন অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছেন।
শোষণ, বঞ্চনা, মূল্যবোধের নিম্নযাত্রার জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য যে অনেকাংশে দায়ী এ কথাটি প্রমাণ করার জন্য প্রথাগত গবেষণা করার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার মানুষকে যেমন দ্রম্নত সাম্প্রদায়িক করে তোলা যায় একইভাবে নানা অর্জনের জন্য ক্ষ্যাপা ষাঁড় হয়ে অনৈতিক কাজের দিকে ঠেলে দেওয়াও যায় খুব সহজে।
\হমুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বে বাঙালি ফিরে গিয়েছিল চর্যাপদের যুগে। মধ্যযুগের সুবর্ণ সময়কে অন্তরে ধারণ করেছিল, যখন ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য চন্ডীদাস, আবদুল হাকিম তৎপর ছিলেন। সেই সময়কে ধারণ করে মানবিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আধুনিক অস্ত্রের সামনে বাঁশের লাঠি নিয়ে লড়াই করতে উদ্ধত হয়েছিল মানুষ। যে কোনো জাতিকে মূল্যবোধে সমৃদ্ধ করতে অতীত ঐতিহ্য থেকে শক্তি ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। তবে সবার প্রতি থাকতে হয় সমদৃষ্টি। আমরা কী পারব হাসন, লালন, রাধারমণের ঐতিহ্যের বাংলাদেশকে মানবিক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।
শেখর ভট্টাচার্য : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক