আজ থেকে ছয় দশক আগে ২০ নভেম্বর, ১৯৬৫-এ জিয়া-খালেদা দম্পত্তির ঘর আলোকিত করে আবির্ভাব ঘটে একটি ফুটফুটে শিশুর- যার নাম রাখা হয় তারেক রহমান পিনু। সময়ের পরিক্রমায় শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে আজ তিনি পৌঢ়ের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছেন। দীর্ঘ এ চলার পথে নিজেকে একজন যোগ্য, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ও প্রতিশ্রম্নতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাকে নানান চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। রাজনীতি তার রক্তে, তাই নিজেকে একজন রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নিরলস রাজনীতির অঙ্গনে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ ধূলিধূসরিত পথ পায়ে মাড়িয়ে কিংবা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের বন্দরে পৌঁছার ও পৌঁছানোর নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির অঙ্গনে তারেক রহমান আজ এক উচ্চকিত নাম।
তরুণ প্রজন্মের উদীয়মান রাজনীতিক তারেক রহমানের সামনে কেবল দেশ ও দেশের আপামর জনসাধারণ। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ধ্বনি তাকে সব সময় আন্দোলিত করে। তাই তো দেশ ও জনকল্যাণের ধ্যান-ধারণা থেকে ক্ষণকালের জন্যও নিজেকে বিচু্যত রাখতে পারেন না। দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে বিগত কয়েক বছরের তার চিন্তাভাবনাগুলোকে মনোযোগ দিয়ে দেখলে এবং একটু বিচার-বিশ্লেষণ করলে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে তাকে আমরা যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে পারব বলে আমার মনে হয়। এবার আসুন, আমরা তার রাজনৈতিক চিন্তভাবনা ও ধ্যানধারণাগুলো একটু বিচার-বিশ্লেষণ করি। নব্বই দশকের শেষ দিকে তারেক রহমান রাজনীতির অঙ্গনে আলোকবর্তিকার মতো প্রজ্বলিত হয়ে ওঠেন। মায়ের ছায়াসঙ্গী হয়ে দেশময় চষে বেড়াতে থাকেন। দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করে দলকে নিয়ে যান এক অনন্য উচ্চতায়। ফলস্বরূপ, ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের ভূমিধস বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আর এই ভোট বিপস্নবের নেপথ্য কারিগর হিসেবে নাম ওঠে এলো তারেক রহমানের। মূলত তখন থেকেই তার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ সবই রচিত হয় জনগণকে কেন্দ্র করে। সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিমন্ডলে অত্যন্ত বিচক্ষণ পরিবারে জন্ম হলেও তার চাল-চলন, কথা-বার্তা, পোশাক-আশাকে ভীষণ সহজ, সরল ও সাবলীল ভঙ্গি ফুটে ওঠে। বংশ গৌরবের অহংকার কিংবা বিত্তের প্রভাব কখনোই তাকে প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। রাজনীতিকে তিনি সেবা এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি হিসেবে বেছে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কর্মযজ্ঞের বিস্তীর্ণ ভুবনে। দেশব্যাপী শুরু করেন তৃণমূল ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন। নিজেকে বিলিয়ে দেন শতভাগ উজাড় করে। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের এবং প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদের যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে চারণ রাজনীতির এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। এভাবেই তিনি অসহায় মানুষের পাশে আলোর প্রতীক আর রাজনীতির অঙ্গনে তেমনি চিন্তাশীল এক নতুন প্রজন্মের প্রতীক হয়ে ওঠেন। কেবল তা-ই নয়, ২০০৫ সালে তিনি সব রাজনৈতিক দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনেরও ডাক দিয়েছিলেন- আজ দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পরও সেই জাতীয় সরকার গঠন প্রক্রিয়ার পথেই হাঁটছেন তিনি। ২০২৪-এ এসেও তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে 'একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় সরকার' গঠনের কথা বলছেন। গণমানুষের কথা বলছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার নিমিত্তে শান্তি-সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার কথা বলছেন। গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বিলোপ সাধন করে নবীন-প্রবীণ-তরুণদের সমন্বয়ে রাজনীতির এক নবদিগন্তের সূচনা করে সম্মুখপানে অপ্রতিরোধ্য বেগে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন।
রাজনৈতিকভাবে বহুধা বিভক্ত এবং বহু ধর্মীয় ও বহু ভাষাভাষীর বাংলাদেশের জনসাধারণকে একই পতাকা তলে সমবেত করে উন্নয়নের দিকে ছুটন্ত ঘোড়ার মতো ধাবিত করার লক্ষ্যে দেশের সব রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে তারেক রহমানের কণ্ঠে ২০০৫-এ উচ্চারিত হয়েছিল, 'রাজনীতি করতে হবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে।' জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে তিনি দলমতনির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'রাজনৈতিক মত পার্থক্য মঞ্চে থাকুক, দেশ ও জনগণের উন্নয়নে নয়।' শুধু বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমেই নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে পিতার অনুসৃত ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কর্মক্ষেত্রের বিস্তীর্ণ ভুবনে। ১৯ দফার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে দিন-রাত দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে চষে বেড়াতে থাকেন। রাজনীতির অপসংস্কৃতির রোষানলে পড়ে এতদিন যারা রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন কিংবা রাজনীতিবিমুখ হয়ে নীরবে-নিভৃতে দিনাতিপাত করতেছিলেন তাদের মূলধারার রাজনীতির স্রোতে ফিরায়ে আনার জন্য নানান কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি দেশ ও জনগণের কল্যাণে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন এবং এখনো রাখছেন। যদিও তিন সশরীরে আমাদের মাঝ উপস্থিত নেই। কিন্তু দেশকে নিয়ে তার চিন্তাভাবনা ও কর্মপরিকল্পনার গভীরতা এবং দেশের ভবিষ্যতের প্রতি তার দায়বদ্ধতা যেন এক শিকড়ের টানে বাঁধা মহিরুহের মতো- যা শত ঝড়-তুফানেও টিকে রয়েছে। তাই তো স্বাধীন-সার্বভৌম এক উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন মিশে রয়েছে তার প্রতিটি পদক্ষেপে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুগের পরিবর্তন ও সময়ের চাহিদার বাস্তবায়নে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তার এই কর্মসূচির সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে একদল দক্ষ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের নামিয়ে দিয়েছেন হাটে-মাঠে-ঘাটে। তারা তারই হয়ে কাজ করছেন নিরলস। দেশের আপামর জনসাধারণও এই ৩১ দফা সাদরে গ্রহণ করছেন এবং তার এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন।
বিএনপির কান্ডারি হিসেবে তারেক রহমানকে মনে রাখতে হবে আমাদের রাজনৈতিক আকাশের দুর্যোগের ঘনঘটার কালো মেঘের ছায়া এখনো কেটে যায়নি। এখনো আমরা সংকট মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বলয়ে প্রবেশ করতে পারিনি। আমাদের ভবিষ্যৎ চলার পথ বড়ই বন্ধুর বলে মনে হচ্ছে। তাই, যে কোনো দুর্যোগ কিংবা বিপদের প্রথম দর্শনেই এই সময় সাপেক্ষ দলপ্রেমিকদের জনস্রোত উবে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই আগে বিএনপিতে আদর্শ ও চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে কলমের সাহায্যে, লেখালেখির মাধ্যমে। নতুন প্রজন্মকে যোগ্য, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ও প্রতিশ্রম্নতশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যুগোপযোগী, সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কার্যকর করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সফল রাজনৈতিক দলসমূহের কার্যাবলি পর্যবেক্ষণ করে অনুকরণীয় পন্থাসমূহ নিজ দলের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করলে রাজনৈতিকভাবে দল প্রাগ্রসর পৃথিবীর রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। ফলে, ভবিষ্যতে দল যে কোনো গভীর সংকট ও সমস্যার মুখোমুখি হলে তা অতি সহজে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। আদর্শ ও চেতনানির্ভর রাজনীতিই সব রাজনৈতিক সংকট ও সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের মূল প্রতিপাদ্য মন্ত্র। তাই দলের কান্ডারি হিসেবে তারেক রহমানকেই এই মন্ত্রের সাধন নিশ্চিত করতে হবে; অতপর, উদিত হবে সাফল্যের সোনালি সূর্য।
আজ তারেক রহমানের ৬০তম জন্মদিন। এ দেশের নবীন-প্রবীণ, তরুণ সমাজ অধীর আগ্রহে ছিল তারেক রহমান তাদের মাঝে এসে তার এই জন্মদিন উদযাপন করবেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, মাটির মমতায় সিক্ত তারেক রহমান কোটি কোটি বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়েও আজ ভিনদেশের মাটিতে পড়ে রয়েছেন- যা খুবই কষ্টকর ও বেদনাদায়ক। কিন্তু সমগ্র জাতি আজ তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রহর গুণছে অধীর আগ্রহে। সবাই কায় মনে বলছে, তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার ছোঁয়ায় যেন কোটি কোটি মলিন ঠোঁটে ফোটে হাসির ফোঁয়ারা। পরিশেষে, তার জন্মদিনে একরাশ রক্তিম গোলাপ শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রার্থনা করছি-
তোমার জীবন হোক ধূপের মতো দহনে দহনে দিতে তৃপ্তি,
তোমার জীবন হোক চন্দনের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে দিতে দীপ্তি।
এম. সাইফুর রহমান : সাহিত্যিক, গবেষক ও কলামিস্ট