কেমন হবে বিশ্বরাজনীতি

এবার ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন উচ্চতর ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার সূচনা করতে পারে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

তানভীর আহমেদ
আগামী ২০ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর সন্দেহাতিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মগুলো পুনর্লিখন করার জন্য মূল লাগাম ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ডেমোক্র্যাটদের হাতেই থাকবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেডারেল সরকারে আমূল পরিবর্তন আনতে একটি সুস্পষ্ট অভ্যন্তরীণ নীতি বা এজেন্ডা প্রণয়ন করতে চাইবে। তবে যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকা ছাড়াও পুরো পৃথিবীর রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। গত চার বছর ট্রাম্প ক্ষমতার বাইরে থেকে সেই বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ বিজয়ের প্রসঙ্গ কারো জন্যই হতবাক হওয়া উচিত নয়। ৪৫তম এবং ৪৭তম রাষ্ট্রপতি একটি অভূতপূর্ব শক্তিশালী অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ওয়েভে নাড়া দিয়েছে। ট্রাম্পের এই ব্যালট বাক্সের বিপস্নব বিশ্বজুড়ে প্রতিটি শাসক দলকে এক ধরনের হুঁশিয়ারিও দিল যে এভাবেও কামব্যাক করা যায়। অথচ মার্কিন নির্বাচনী ডিবেট চলাকালীন প্রকৃতপক্ষে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এ বছর ধনী দেশগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম পারফর্মার ছিলেন- যা আমরা কমলার সুশৃঙ্খল নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া, অনেক রাজনীতি সমালোচকরা ট্রাম্পের ঐতিহাসিকভাবে অজনপ্রিয় প্রার্থিতা এবং আমেরিকার বিশ্ব-বিধ্বংসী অর্থনীতির কথাও বলেছেন। ট্রাম্পের প্রচারণায় উচ্চ অভিবাসন চাপ মোকাবিলা করা এবং ক্রমাগত দ্রব্য মূল্যের উচ্চগতির বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও মূলত বাইডেন প্রশাসনের নড়বড়ে অবস্থানের ফলে ভোটারদের ব্যাপক হতাশা তৈরি হয়েছিল ডেমোক্র্যাটদের প্রতি। যার ফলে, ট্রাম্পের ব্যালট বিপস্নব আরও গতি পেয়েছে। এছাড়াও ট্রাম্পের হাইপারপোলারাইজড তথ্য পরিবেশনা আমেরিকাকে পক্ষপাতমূলক ইকো চেম্বারে বিভক্ত করেছে। এই হেডওয়াইন্ডগুলোকে কমলা হ্যারিস তার নির্বাচনী প্রচারণায় সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারেননি। আমেরিকার নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা যায় কোনো দলই হোয়াইট হাউসের দখল ধরে রাখতে পারেনি, যখন অনেক আমেরিকান মনে করে যে দেশটি ভুল পথে রয়েছে এবং সে কারণে মূলত ক্ষমতাসীনদের গ্রহণযোগত্যা কমে যায়। এই আলোকে দেখলে হ্যারিসের পরাজয়ের সম্ভাবনা যে ছিল না, তা বলা যাবে না। গত বিশ বছরের মধ্যে ট্রাম্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে ভোটে জয়ী প্রথম রিপাবলিকান। যিনি প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটেও আশাতীত ভালো করেছেন। ট্রাম্প কেবল একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নয়, বরং কংগ্রেসের একীভূত নিয়ন্ত্রণ এবং রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গেও অফিস গ্রহণ করবেন। অনেকে আশা করেন যে, দ্বিতীয়বার ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কেবল তার প্রথম মেয়াদের পুনরাবৃত্তি হবে। ট্রাম্পের বিগত আমলে যখন কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি, আফগানিস্তানে আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান ছাড়া। এছাড়াও, ট্রাম্প বেশ কিছু উলেস্নখযোগ্য বৈদেশিক-নীতি গ্রহণের ফলে সফলতা অর্জন করেছেন। যার মধ্যে একটি পুনরুজ্জীবিত হওয়া উত্তর আমেরিকার মুক্তবাণিজ্য চুক্তি [বর্তমানে মার্কিন-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি], মধ্যপ্রাচ্য আব্রাহাম অ্যাকর্ডস, ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে ন্যায্য খরচ ভাগাভাগি এবং এশিয়ায় নতুন শক্তিশালী নিরাপত্তা জোট। তদুপরি, ট্রাম্প এখনো সেই একই ব্যক্তি যিনি চার বছর আগে ছিলেন। এবার ক্ষমতা গ্রহণের পর হয়তো ভালো কিংবা আরও মন্দ হতে পারেন। একথা বলায় যায় যে, তার বিশ্বদর্শন অপরিবর্তিত রয়েছে। যেমন তার বিদেশ নীতিতে দৃঢ়ভাবে একতরফা বাদী এবং লেনদেনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ট্রাম্প যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিল, তখন ব্যক্তিগতভাবে শাসন ব্যবস্থায় অতটা মনোযোগী না হলেও নানা সময় বিতর্কিত মন্তব্য অথবা কর্মকান্ডই ছিল তার মূল লক্ষ্য। তবে এবার অনুমান করা যায়, ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসে প্রশাসনে তার মতাদর্শে বিশ্বাসী অভিজ্ঞ সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে শুরু থেকেই 'আমেরিকা ফার্স্ট' এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত থাকবে। প্রথম শাসনামলে ট্রাম্পের রেখে যাওয়া অনেক কর্মকর্তাকে রাখেনি বাইডেন প্রশাসন। তারপরও প্রশাসনের আনাচে-কানাচে যেসব ট্রাম্পভক্ত বাইডেন আমলে অবহেলিত হয়েছে তাদের ট্রাম্প প্রশাসনে বড় বড় জায়গায় প্রতিস্থাপন করবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই কর্মকর্তারা ট্রাম্পের নীতি অনুসরণে আরও অগ্রগামী হবেন। এছাড়াও, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের পররাষ্ট্রনীতির উপদেষ্টারা তার প্রথম মেয়াদের শুরুতে থাকা উপদেষ্টাদের তুলনায় অনেক বেশি অনুগত হবেন এবং প্রথম মেয়াদের শেষের দিকের উপদেষ্টাদের তুলনায় অনেক বেশি অভিজ্ঞ হবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো ট্রাম্প বিশ্বরাজনীতিকে বা জিওপলিটিক্সকে যেভাবে রেখে গিয়েছিলেন তার চেয়ে বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ওই সময় সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে আমেরিকান অর্থনীতিতে সুদের হার তুলনামূলক কম ছিল। যেটাকে ট্রাম্পের কৃতিত্বই বলা যায়। নিজে ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে অবশ্য তিনি অর্থনীতির বিষয়গুলো ভালো বুঝতেন। কিন্তু এখন দু'টি আঞ্চলিক যুদ্ধ, চীনের সঙ্গে তীব্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা কিংবা রাশিয়া, ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক ও রাসায়নিক শক্তিধর রাষ্ট্র যারা এখন আরও ক্ষ্যাপাটে হয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্র নেতারাও ট্রাম্পের আগে-পরে অনেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউসে আসতে যেতে দেখেছেন অথচ তারা এখনো ক্ষমতায় আছেন। সব মিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকান কর্তৃত্ববাদের ওপর ব্যাপক চাপ থাকবে সামনের দিনগুলোতে। তাছাড়া, একটি মন্থর বিশ্ব অর্থনীতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিঘ্নিত প্রযুক্তি ট্রাম্পের নেতৃত্বের ওপর সম্পূর্ণ নতুন দাবি রাখবে। নর্থ-ইস্টার্ন গেস্নাবাল নিউজ বলছে ট্রাম্পের জয়ের পরপরই শেয়ার বাজার চাঙা হয়েছে। ২০১৬ সালের চেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে 'আমেরিকা ফার্স্ট' বৈদেশিক নীতির প্রভাবগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী- যা থেকে ট্রাম্প প্রশাসনে ভালো ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। ট্রাম্প তার লেনদেন পদ্ধতির মাধ্যমে কিছু বৈদেশিক-নীতিতে জয়লাভ করতে সক্ষম হবেন। তাছাড়া, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখবার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। উদাহরণস্বরূপ, বাইডেন প্রশাসন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে সক্ষম হলেও ট্রাম্প চীন বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থান নেবেন- যা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় চীনা আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর চাপ দিয়ে শুরু হবে। ট্রাম্প শুল্ক বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করলে চীনারা বরং প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে আলোচনার জন্য জায়গা তৈরির চেষ্টা করতে পারে। এই বিষয়টিকে ট্রাম্প কীভাবে বিবেচনা করবেন তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন বিশ্ববাসীকে অপেক্ষা করতে হবে। এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব শুধুই চীনের ওপর ফেলবে না, তৃতীয় বিশ্বের দেশ কিংবা অন্য দেশও আক্রান্ত হতে পারে। সর্বোপরি, চীন গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় সংকট এড়াতে নিজেদের জন্য সাবধান পথ আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে। তবে শুল্ক নিয়ে এই দ্বন্দ্বকে ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক মন্ত্রিপরিষদ এবং কংগ্রেসনাল রিপাবলিকানদের সমর্থন চীন-আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি করবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। ফলাফল হবে একটি নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ- যা শেষ পর্যন্ত সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যকে শান্ত করার কথা বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি আরবকে 'আব্রাহাম অ্যাকর্ডস'-এ অন্তর্ভুক্ত করবার চেষ্টা করতে পারেন। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সৌদি আরবের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে বাইডেন প্রশাসন সেই সম্পর্ক ঠিক রাখেনি। আমরা দেখেছি প্রথমবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০১৭ সালের মে মাসে তিনি প্রথম বিদেশ সফর করেন সৌদি আরবে। সৌদি প্রিন্স সালমানের সঙ্গে ট্রাম্পের ভালো সম্পর্কও ছিল। অপর দিকে ইসরায়েলকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতাও জারি রাখবেন। কারণ, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাম্প্র্রতিক ইরানের পারমাণবিক হুমকিকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে আরও বেশি সহায়তা চাইবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির বিষয় হলো ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে আকুণ্ঠ সমর্থন করবেন। বিপরীতে ট্রাম্প একদিনের মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। সম্ভবত তিনি ক্ষমতা গ্রহণের আগেই- একতরফাভাবে রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং ভস্নাদিমির পুতিনকে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেবেন মেনে নেওয়ার জন্য। যা বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতময় অঞ্চলের বিনিময় অর্থাৎ রাশিয়াকে খুশি রেখেই যুদ্ধবিরতি দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে, উভয় পক্ষ ট্রাম্পের প্রস্তাব বিবেচনা করবে কিনা অথবা কিয়েভ নিজেদের টেরিটরি বিনিময়ের শর্তাবলি গ্রহণ করবে কিনা, তা একটি খোলা প্রশ্ন। অবশ্য এ বিষয়ে ইউরোপ ইউনিয়ন কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। ফ্রন্টলাইন ন্যাটো দেশগুলো যেমন- পোল্যান্ড, বাল্টিকস এবং নর্ডিক রাষ্ট্রসমূহ রাশিয়ান আগ্রাসনকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে। এই রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ খরচ বহন করতে ইচ্ছুক হবে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামিনদার হয়। অন্য রাষ্ট্র যেমন হাঙ্গেরি মতাদর্শগত কারণে, রাজনৈতিক কারণে ইতালি, বা আর্থিক কারণে জার্মানি চুক্তি ভাঙার সুযোগ উপভোগ করতে পারে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদটি এমন অনুঘটক হতে পারে- যা অবশেষে ইউরোপকে একত্রিত করবে। সেই সঙ্গে ইউরোপে কৌশলগতভাবে আরও শক্তিশালী অটোনোমাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারে। বিপরীত দিক বিবেচনায় এমনও হতে পারে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন আরও শক্তিশালী হতে পারে। ফলে, ট্রান্সআটলান্টিক জোট মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং রাশিয়ান আগ্রাসনকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। যা হোক, এবার ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন উচ্চতর ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার সূচনা করতে পারে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তানভীর আহমেদ : প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক