তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের পথে সহায়তা করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সাম্যবাদী, ন্যায়ভিত্তিক এবং অসাম্প্র্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব।
প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, সাধারণত পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এসব দেশে বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং মৌলিক চাহিদাগুলোর অপ্রতুলতা অন্যতম প্রধান সমস্যা। এর মূল কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বৈষম্যমূলক নীতিমালা, যেখানে সম্পদ ও সুযোগের বণ্টন অসামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং অসাম্প্র্রদায়িক সমাজ গঠনই হতে পারে এসব দেশের অগ্রগতির সঠিক দিশা। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ তাদের মত প্রকাশ করতে পারে এবং সমাজতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে উন্নয়ন এবং সমতামূলক সমাজ গঠনের জন্য একটি কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
পুঁজিবাদী গণতন্ত্র হলো এমন একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন সম্পদ এবং বাজার অর্থনীতি প্রাধান্য পায়। এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুনাফার প্রাধান্য, প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি এবং সরকারের সীমিত হস্তক্ষেপ। এটি সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, যা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে সহায়তা করে। তবে এই ব্যবস্থায় আয় ও সম্পদের বণ্টনে চরম বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য বাড়তে থাকে। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সুবিধা যেমন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তেমনই এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। বিশেষত, এই ব্যবস্থায় কিছু মানুষ অত্যন্ত ধনী হয়ে ওঠে আর বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র থেকে যায়। এই আয় বৈষম্যের কারণে সমাজে হতাশা ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলোকে উলেস্নখ করা প্রয়োজন। এখানে সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাব এবং কর্পোরেটদের কর্তৃত্বব্যবস্থা সমাজে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে। ফলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয় এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সীমিত থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই ব্যবস্থায় সামাজিক শোষণ বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্যের মাত্রা প্রকট হয়। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থায় এই দেশগুলোতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সৃষ্টির সুযোগ থাকে, কিন্তু তা সামাজিক বৈষম্যের সমস্যাকে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে গণতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয় এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে দায়িত্বের ভারসাম্য থাকে এবং প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এই ব্যবস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থান রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকে, যাতে প্রতিটি নাগরিকের জীবনমান উন্নত হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সম্পদের বৈষম্য হ্রাস করে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত করে। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বেকারত্বের সমস্যাকে সমাধান করতে সাহায্য করে। এছাড়া, এই ব্যবস্থায় অসাম্প্র্রদায়িকতা এবং সাম্যবাদিতার ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব, যেখানে ধর্ম-বর্ণ এবং জাতিগত ভেদাভেদ দূর হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রের অধীনে অর্থনৈতিক সম্পদকে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, কিউবা এবং নরওয়ের মতো সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দেশগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে সাধারণ মানুষের কল্যাণ, যা ব্যক্তিগত মুনাফার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই ধরনের রাষ্ট্রীয় ভূমিকা বিশেষ প্রয়োজনীয়। কারণ এখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং নিম্নমানের শিক্ষার প্রভাব ব্যাপক। যদি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের এই ধরন অনুসরণ করে, তবে এটি জাতিগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের জন্য একটি উপযোগী ব্যবস্থা হতে পারে। তবে এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে সম্পদের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের কেন্দ্রীকরণ ঘটাতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা অর্থনৈতিক উদ্ভাবনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রের ওপর অনেক বেশি কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ এবং সুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মতামত ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হলে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দেশগুলোর বেশিরভাগ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে এবং তাদের মৌলিক অধিকার প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যায্যতা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আর্থসামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সহায়ক হতে পারে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে ধনী-গরিবের ব্যবধান হ্রাস করা যায় এবং উন্নয়নের সুফল সবার মাঝে সমভাবে বিতরণ করা যায়। এছাড়া, তৃতীয় বিশ্বের দেশে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র অসাম্প্র্রদায়িক সমাজ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এই ব্যবস্থায় সব ধর্ম, জাতি ও সম্প্র্রদায়ের মানুষের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়, যা অসাম্প্র্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, সাম্যবাদিতা এবং অসাম্প্র্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র একটি কার্যকরী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতাগুলো, যেমন ধনী-গরিবের বৈষম্য এবং সম্পদের কেন্দ্রীভবন, এসব দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা হিসেবে রয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের পথে সহায়তা করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সাম্যবাদী, ন্যায়ভিত্তিক এবং অসাম্প্র্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও লেখক