রক্ষা করতে হবে পুকুর-জলাশয়

দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুকুর ও জলাশয় নীরবে ভরাট চলছে। আমরা তেমন গরজ মনে করছি না বলেই ইতিহাস ঐতিহ্যের স্থাপনাসহ পুকুর, দীঘি ধীর ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকরী ভূমিকা অপরিহার্য।

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শতদল বড়ুয়া
চট্টগ্রাম মহানগরীতে যে হারে লোক বাড়ছে সে হারে কিন্তু আর কিছুই বাড়ছে না, বরঞ্চ আনুপাতিক হারে কমছে। আগামীতে এ নগরীর দৃশ্যপট আরো চমৎকৃত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে, সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে আমাদের জন্য তেমন কোনো সুখবর নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত নানা দান। বহুকাল পূর্বে কেউ বাড়ি করার পরিকল্পনা করলে পুকুর খনন অবধারিত ছিল। সমতল বা জলাশয় জায়গা থেকে মাটি তুলে মাটির ঘর তৈরি করত। একটা মাটির ঘর তৈরি করা মানে সৌখিন একটা কাজ করার মতো। যেখান থেকে মাটি তুলল সেটা হয়ে গেল পুকুর। জমিদারি প্রথার সময়ে এ ধরনের মানসিকতা আঁচ মিলে বেশি। গ্রাম-শহর সর্বত্র পুকুর একটা কমন জিনিস। দুইশত বছর পূর্বে এই মহানগরীতে কম করে হলেও একশ'র অধিক পুকুর ছিল। লোক বৃদ্ধির কারণে পুকুর ভরাট কার্যক্রম ধীরগতিতে চলমান। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি। প্রয়োজন হলো পুকুর ভরাট করে বাড়ি তৈরি করে ফেললাম। দেখা দেখিতে আমরা ধ্বংসের কৌশল আয়ত্ত করছি। বর্তমানে মহানগরীতে হাতে গোনা কয়েকটি পুকুর আছে। দিন দিন সর্বত্র পানির সংকট বাড়ছে। আগের মতো বর্ষাকালও অনুপস্থিত। বৃষ্টির পানিতে পুকুর, দীঘি, নালা, খাল-বিল, সাগর, মহাসাগরের যৌবনের দীপ্তিময় শিখা সমুজ্জ্বল থাকলেও বর্তমানে সেই দৃশ্য বহমান নেই। একমাত্র কারণ পরিবেশ বিরুদ্ধ আচরণ। মানুষ নিজের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। সবুজ বনানী ধ্বংস, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা, পুকুর, দীঘি ও জলাশয় ভরাট করার কারণেই পরিবেশ মুমূর্ষু। যার কারণে প্রকৃতির রূপও গেছে পাল্টে। বৃষ্টি শুরু হলে থামতে চায় না, এক এলাকায় বৃষ্টি হলে অন্য এলাকায় রোদ। সাগরে মিঠা পানি কমে যাওয়ায় নুনা পানিতে সাগর সয়লাব হচ্ছে। লবণাক্ত পানি পান করা যাচ্ছে না। সামর্র্র্থ্যে যারা পারছে তারা বিশুদ্ধ পানি কিনে পান করছে। শুধু পুকুরের কথা চিন্তা করলে হবে না, জলাশয়, ডোবা, দীঘি- এগুলো রক্ষায়ও আমাদের ভাবতে হবে। তবে আমাদের জন্য সুখবর হলো পুকুর ও দীঘি রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তৎপর রয়েছে। নানা প্রচার মাধ্যমে জানা যায়, ইতোমধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাধারণ জনগণের ধারণা ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর ও দীঘি ভরাটের বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। অনেক পুকুর দীঘির মালিকরাও এ বিষয়ে যে আইন আছে তা জানত না। এখন যেহেতু আইন বিষয়ে সবার জ্ঞাত সেহেতু সাধারণ জনগণ চায় আইন যেন সবার জন্য সমান কার্যকর হোক। শুধু শহর কেন্দ্রিক নয়, দেশের গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিকেও দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। পুকুর, জলাশয়, ডোবা ও ঢেবা ভরাট পলস্নীতেও সমানতালে চলছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে- তা হলো গরিব লোকে পুকুর ছাড়া আর কিছু নেই। সংসারের প্রয়োজনে পুকুর ভরাট করে ঘর তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সাহায্য-সহযোগিতা করা যেতে পারে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচিত হবে গ্রাম অঞ্চলের পুকুর ও দীঘি রক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আইনের সুনির্দিষ্ট ধারা অবগত করিয়ে তাদের দায়িত্ব দেওয়া। এভাবে হয়ত-বা সবাই সচেতন হবে। কেউ সহজে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজে যেতে চাইবে না। পুকুর, দীঘি ও ঢেবায় অনেকে মাছ চাষ করে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ চালাচ্ছে। পুকুর ও দীঘি পাড়ে নানা ধরনের সবজি উৎপাদন নতুন কোনো খবর নয়। বর্তমানে সবজির মূল্য সীমাহীন বৃদ্ধি। পুকুর ও দীঘি পাড়ে সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা মেটানো তেমন কোনো আহামরি ব্যাপার নয়। কিন্তু আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি না। পলস্নীর অধিকাংশ এলাকায় পানির তীব্র সংকট। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো মহলস্না বা পাড়ায় একটা পুকুর থাকে তাহলে পানির চাহিদা মেটানো সহজ হয়। একটা পুকুর মানে পানির ট্যাংক। যেই পুকুর বা দীঘি জলাশয় আমাদের অহোরাত্র সেবা দিয়ে যাচ্ছে- সেগুলো রক্ষা করা না গেলে আমরাই হব চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা অনেকে ভুলে গেছি সেই ঢাকার কারওয়ান বাজারের বিএসইসি দশতলা ভবনের অগ্নিকান্ডের কথা। সে ঘটনায় বেশ কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি তিনজনের প্রাণহানি, শতাধিক আহত এবং অনেকে হয়ে গেছে পঙ্গু। এটাতে দমকল বাহিনী পর্যাপ্ত পানি ছিটাতে পারেনি নানা প্রতিবন্ধকতা ও কাছে পানি জোগান না পাওয়ায়। যদি আশপাশে কোনো পুকুর বা দীঘি থাকত তা জীবনহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো। বিপদের কোনো হাত-পা নেই। আমরা কোন সময় কি ধরনের বিপদের সম্মুখীন হব, কেউ জানি না। তাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থ হলে বংশপরম্পরায় আমরা নানাবিধ ভোগান্তিতে থাকব। একটা সুবিধা পাওয়ার জন্য হাজারো সুবিধাকে বিতাড়িত করে দিচ্ছি আমরা জেনেশুনে। পুকুর, দীঘি, জলাশয়, ডোবা ও ঢেবার উপকারিতা লিখে শেষ করা যাবে না। এ ধরনের সুবিধা পাওয়া জিনিসকে আমরা নানা অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি না, ঐতিহ্যের একটা অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য রক্ষা করা গেলে পরিবেশ বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচলে আমরা নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারব। তাই পুকুর, দীঘি, জলাশয়, ডোবা ও ঢেবা ভরাটে বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুকুর ও জলাশয় নীরবে ভরাট চলছে। আমরা তেমন গরজ মনে করছি না বলেই ইতিহাস ঐতিহ্যের স্থাপনাসহ পুকুর, দীঘি ধীর ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকরী ভূমিকা অপরিহার্য। মানুষ আইনকে শ্রদ্ধা করে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে নিজের সুবিধার জন্য পুকুর বা দীঘি মালিকরা প্রকৃতির ক্ষতির পাশাপাশি দেশের সাধারণ জনগণ অশনিসংকেতের কবলে পড়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাধারণ জনগণকে সচেতন করার জন্য অধিকতরভাবে প্রচার চালানোসহ কর্মকৌশল নির্ধারণ করা গেলে ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা কামিয়াব হব, নয়তো আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হব। শতদল বড়ুয়া : সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং প্রাবন্ধিক