নবান্নের বাংলাদেশ ও হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রূপম চক্রবর্তী
নবান্ন বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ধানের বা পিঠার উৎসব। বাংলাদেশে যতগুলো উৎসব হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম নবান্ন উৎসব। হেমন্তকালের এই উৎসব ছিল সর্বজনীন। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব হচ্ছে নবান্ন, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন এর মধ্যে অন্যতম। 'নবান্ন' শব্দের অর্থ 'নতুন অন্ন'। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। নতুন আমন ধান কাটার পর সে ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। নবান্নের নতুন ধানের গন্ধ আজও শরীরে লেগে আছে। যে গন্ধের সঙ্গে মিশে শ্রমজীবী কৃষকের হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনা আর কষ্টের ইতিহাস।
কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণের নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন কৃষক এবং তার পরিবার। গ্রামবাংলার ফসল ঘরে তোলার পর মাঠের দৃশ্যটিও কবি জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিতে অত্যন্ত চমৎকার হয়ে ফুটে উঠেছে 'প্রথম ফসল গেছে ঘরে/হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/শুধু শিশির জল/অগ্রহায়ণের নদীটির শ্বাস/হিম হয়ে হয়ে আসে/বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা/বরফের মতো চাঁদ ঢলিয়াছে ফোয়ারা/ধানক্ষেতে-মাঠে/জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা/ঘরে গেছে চাষা/ ঝিমাইছে এই পৃথিবী।'
কপিলভোগ, কাজলা, কামিনী, কুসুমকলি, ঘৃতশাল, চন্দনচূড়া, চন্দ্রপুলি, চিনিসাগর, জটাশালী, জনকরাজ, জামাইভোগ, দাদখানি, দুধকমল, নীলকমল, পঙ্খিরাজ, পদ্মরাগ, হীরাশাল, মানিকশোভা, মুক্তাঝুরি, আকাশমণি, নামের রকমারি সব ধানে সমৃদ্ধ বাংলার জনপদ। এসব ধানের উৎপাদনের সঙ্গে উৎসবের সংযুক্তি তো অবশ্যই থাকতে হয়।
ধান-চালের অভাব, খাদ্যের অভাব, গরম ভাতের অভাব, দুর্ভিক্ষ, অকাল যুদ্ধ, মন্বন্তর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করার প্রেরণা যুগিয়েছে নবান্ন উৎসব? গ্রাম্যচাষিদের অনেক লড়াই আর পরিশ্রমের ফসল নিয়ে মাঠ থেকে বাড়িতে এসে নতুন জীবনকে অঙ্গীকার করে এই নবান্ন উৎসবে মেতে উঠে। পুরনো অনেক রীতি মেনে আজও গ্রাম বাংলার কিছু ঘরে বেঁচে রয়েছে নবান্ন উৎসব। এই উৎসবের সঙ্গে মিশে থাকে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির আনন্দ। তাই নতুন ধান ঘরে উঠলে পিঠে-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। পিঠা-পায়েসের আদান-প্রদান এবং আত্মীয়স্বজনের আগমনে পলস্নীর প্রতিটি গৃহের পরিবেশ হয়ে ওঠে মধুময়। বাংলার লোকায়ত উৎসব নবান্ন উৎসব সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম। আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি, সে গ্রামটি মুসলিমপ্রধান গ্রাম। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা নতুন ধান কেটে বউ, মেয়ে-জামাইসহ স্বজনদের দাওয়াত করে আনত। তাদের নিয়েই চলত পিঠাউৎসব। অন্যদিকে সনাতন ধর্মের সংস্কারমতে, অন্নের আরেক নাম প্রাণ। নতুন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা হতো। পরে দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়স্বজনদের নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করতেন। এ উপলক্ষে বাড়ির প্রাঙ্গণে আলপনা আঁকা হতো।
অনেক এলাকায় নবান্নের দিন সূর্য ওঠার আগে কৃষক মাঠে গিয়ে ধানের জমিতে ফুল-তুলসি-চালকলা-ফল দিয়ে নৈবেদ্য প্রদান করেন। বাড়িতে জমির ধানের গোছা কেটে নিয়ে এসে ঘরের দরজায় টাঙিয়ে দেন। গ্রামের বধুরা অপেক্ষা করেন বাপের বাড়িতে নাইওরে গিয়ে নবান্ন যাপনের জন্য। মেয়ে বাপের বাড়িতে আসার পর পিঠা, পায়েস, মুড়ি-মুড়কি আর নতুন চালের ভাত মেয়েকে খাওয়ানোর মাধ্যমে মা-বাবা আনন্দ পেতেন। এই লোকায়িত উৎসব বাংলা সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বানু/
পৌষপার্বণে প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান/
তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায়/হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দায়/গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন/পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন/ নিজের হাতের জমি ধান-বোনা/
বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা/কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসেনি শুভক্ষণ/তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন। কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন-
'মাতা হেরিতেছে নবান্ন আসন্ন উৎসবে/বিমুগ্ধ নয়নে হেরে পরিপূর্ণ ফসলের ভার/অঙ্গ ভরিয়া আছে- আমার বাংলার।' কবি জসীম উদ্দীন লিখেন, 'সবুজে হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে ধান ক্ষেত/পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সংকেত/ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে/ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে/কৃষাণ কনের বিয়ে হবে হবে তার হলদি কোটার শাড়ি/হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা-নাড়ি।'
অনেক আদিবাসী আছেন, যারা প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর নবান্ন উৎসব পালন করেন। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদ্যাপন করে সোহরায় উৎসব। তারা সাত দিন সাত রাত গানবাজনা এবং মদ্যপানের মাধ্যমে এই উৎসব পালন করেন। উসুই উপজাতি অন্নদাত্রী লক্ষ্ণীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করেন। জুমচাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভূরিভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারো উপজাতি ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগালস্না উৎসব। কালের বিবর্তনে বর্তমানে দেশের ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব তার জৌলুস ও ঐতিহ্য হারিয়েছে অনেকটাই। বলা যায় বিলুপ্তপ্রায়। এতদসত্ত্বেও গ্রাম বাংলার পাশাপাশি নবান্ন উৎসব পালিত হয় দেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় কয়েক বছর ধরেই পহেলা অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব উদযাপন হতো। নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বায়স্কোপ জারি আর সারি গানের আসর এখন স্মৃতির পাতায় চলে যাচ্ছে। স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অতীতকে মুছে দেওয়া মানে নিজের ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেওয়া।
রূপম চক্রবর্তী
ঢাকা