শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

সোশ্যাল মিডিয়া :প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

সোশ্যাল মিডিয়া আধুনিক সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করলেও নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া আরও অনেক বেশি। প্রথম উলেস্নখযোগ্য দিক হলো ভুল-ভ্রান্তি তথ্যের প্রচার। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন গুজব ও অসত্য সংবাদ দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে- যা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
মেহেরাব হোসেন রত্ন
  ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সোশ্যাল মিডিয়া :প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

সোশ্যাল মিডিয়া বলতে বুঝি এমন একটা অনলাইন পস্নাটফর্ম যেখানে মানুষ একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি নিজস্ব তথ্য, ছবি, ভিডিও ও মতামত তুলে ধরার সুযোগ রাখে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো: ফেইসবুক, টুইটার, লিংকড-ইন, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ ইত্যাদি। সোশাল মিডিয়ার প্রভাব আজকের সমাজে অত্যন্ত গভীর। এটি শুধুমাত্র যোগাযোগের একটি মাধ্যম নয় বরং মানুষের চিন্তাচেতনা, মনোভাব এবং দৈনন্দিন কর্মকান্ডেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এর উপস্থিতি দৃশ্যমান। সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দ্বৈতভাবে প্রতিফলিত হয়- যা সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে প্রথমেই উলেস্নখযোগ্য হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জ্ঞানের প্রসার বৃদ্ধি। সোশ্যাল মিডিয়া একটি শক্তিশালী তথ্যের পস্ন্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে যেখানে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে মানুষ দ্রম্নত অবহিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পরিবেশগত সমস্যা এবং মানবাধিকার বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কে জানতে পারা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিস্তৃত করে। এটি তথ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে- যা পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের মানুষকে বিশ্বের অন্যান্য অংশের নতুন ধারণা, ঘটনা বা মতামত সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে অবগত করতে সহায়ক। যেমন: জুলাই-আগস্ট ফ্যাসিস্টবিরোধী ২৪-এর গণঅভু্যত্থানের আন্দোলন চলাকালীন, সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আন্দোলনের তথ্য, সমন্বয়কদের নির্দেশনা এবং বিভিন্ন দেশে এর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করেছে। এতে গেস্নাবাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ ও বহির্বিশ্বে এই আন্দোলন এক নতুন মাত্রা তুলে ধরেছিল। সোশ্যাল মিডিয়া বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোশ্যাল মিডিয়া পস্ন্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে তুলে ধরা হ্যাশট্যাগগুলো যেমন: ইসরাইলের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও জোর-দখলের বিরুদ্ধে 'ঝধাব চধষবংঃরহব' আন্দোলন বা 'ঝঃড়ঢ় মবহড়পরফব রহ এধুধ' আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে যদিও আন্তর্জাতিক মহলের টনক নড়েনি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন, জাতিগত বৈষম্য এবং পরিবেশগত সংকটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সারা বিশ্বে আলোচনার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। এ ধরনের আন্দোলন জনগণের মধ্যে ঐক্য এবং শক্তি বৃদ্ধি করে- যা সমাজে ন্যায্যতা এবং পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্বব্যাপী সংযোগের নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। ফলে, সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রের মানুষের একে অপরের মতবিনিময়, সহযোগিতা এবং সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারে- যা বৈশ্বিক সমঝোতা ও সহযোগিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে ব্যবসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং গবেষণার ক্ষেত্রে এটি নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ: বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে শিখছে, গবেষকরা তাদের কাজকে দ্রম্নত এবং বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে। যা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়ক।

সোশ্যাল মিডিয়া বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প এবং দাতব্য কার্যক্রমের প্রচারেও সহায়ক। এটি চ্যারিটি সংগঠনগুলোকে তাদের কার্যক্রম এবং প্রোজেক্টগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। ফলে, দানশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।

সোশ্যাল মিডিয়া শুধু ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে না, এটি একটি শক্তিশালী পস্ন্যাটফর্ম হিসেবে সমাজে বৈষম্য কমাতে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে ভূমিকা পালন করছে।

সোশ্যাল মিডিয়া আধুনিক সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করলেও নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া আরও অনেক বেশি। প্রথম উলেস্নখযোগ্য দিক হলো ভুল-ভ্রান্তি তথ্যের প্রচার। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন গুজব ও অসত্য সংবাদ দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে- যা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

\হযেমন: বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়েই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজব দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলে। ফলে, এ দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রাদায়ের মানুষ নানা ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে- যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। পস্ন্যাটফর্মগুলোতে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। যা কখনো কখনো সমাজে বিভক্তি এবং সহিংসতার জন্ম দেয়। অপপ্রচার বা পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়। যা সমাজের একতা এবং শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন। অনেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি ও মতামত শেয়ার করেন। যা তাদের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। এর পাশাপাশি হ্যাকিং, সাইবার বুলিং, ডেটা চুরির মতো অপরাধগুলোও বাড়ছে- যা ব্যবহারকারীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া পস্ন্যাটফর্মে সাইবার আক্রমণ ও হিংসাত্মক কার্যক্রমও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর শিকার হচ্ছেন, যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে অসচেতন বিশেষ করে নতুন ব্যবহারকারী, তরুণ বয়সীরা যাদের জন্য এটি মানসিক চাপ এবং আত্মবিশ্বাসের সংকট তৈরি করতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়া অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে তরুণ, যুবক, বয়স্ক সব মানুষের মধ্যে অবচেতন প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। নিজেদের জীবন অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করে এবং এর ফলে, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। সামাজিক পস্ন্যাটফর্মে বিশেষ দিনের ছবি, বিশেষ মুহূর্ত শেয়ার করা একটি সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু এটি অনেকের মধ্যে এক ধরনের হতাশা এবং নিঃসঙ্গতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এটি আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের চিন্তা, আচরণ এবং জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, এবং এর সঠিক ব্যবহার সমাজের উপকারে আসলেও অতিরিক্ত বা অবহেলা করা হলে তা ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

মেহেরাব হোসেন রত্ন :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে