মানুষের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে, দিনে দিনে পথশিশুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু, শব্দটাই এক ধরনের ভালোবাসার। যার সঙ্গে মিশে থাকে ভালোবাসা, আদর এবং মমতা। কিন্তু শিশুদের যখন পথশিশু, টোকাই, রাস্তার ছেলে ইত্যাদি নামে ডাকা হয় তখন আপনাদের কেমন লাগে জানি না, তবে আমার বুকে লাগে। কেন একটা শিশুকে পথশিশু বলব? সে রাস্তায় থাকে এজন্য? মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য, তা হলে এই কথাটি তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একটা শিশু রাস্তায় থাকবে? জানি এর কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পাব না। এরপরও আমাদের দেশে পথশিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আসলে এর মূলে রয়েছে অজ্ঞতা, দরিদ্রতা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। আমাদের দেশে একশ্রেণির অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষ অপরিকল্পিতভাবে সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাদের পরিত্যাগ করে। এসব পিতামাতা অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন করে সংসার শুরু করে। এভাবেই বাড়তে থাকে অবহেলিত পথশিশুর সংখ্যা। এসব পিতামাতা সন্তানদের শারীরিক নির্যাতন করে রোজগার করার জন্য। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের অবহেলিত কষ্টের জীবন। ওদের জীবনযাপন দেখে, আমাদের বিবেক কখনো কি নাড়া দেয় না? আজ যে ছোট ছোট বাচ্চার রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করে, ফুল বিক্রি করে কিংবা কিছু খাবে বলে টাকা চায় তাদের ভবিষ্যত কী! যে বয়সে তাদের হাতে থাকা উচিত বইখাতা আজ তাদের হাতে পস্নাস্টিকের বস্তা। রাস্তায় রাস্তায় তারা পস্নাস্টিক খুঁজে। কী নির্মম বেদনাময় দৃশ্য।
২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। যার মধ্যে আড়াই লাখের বেশিই ছিল রাজধানীতে। বর্তমানে বাংলাদেশে পথ শিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই। কেউ বলেন, ২১ লাখ। আবার কেউ বলেন, ২৪ লাখ। তবে এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে। এদের মধ্যে ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর বিছানা নেই, ৮৪ শতাংশ শিশুদের শীতবস্ত্র নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে, ৩৫ শতাংশ শিশু খোলা জায়গায় পায়খানা করে, ৭৫ শতাংশ শিশু ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না, ৮০ শতাংশ শিশু মাদকাসক্ত নেশায় আসক্ত ও এসব পথশিশুরা বিভিন্ন বস্তি, রাস্তার ফুটপাত, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনালে জীবন অতিবাহিত করে।
আমরা বাঙালিরা আবেগপ্রবণ জাতি, আমরা পথশিশুদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি।
পথশিশুদের ৮২ শতাংশই নানা ধরনের পেটের অসুখে আক্রান্ত। এই অসুখের পেছনে যে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ দায়ী, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে এদের মধ্যে চর্মরোগের হারও অনেক বেশি, চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায়। ভাসমান এই শিশুদের ৬১ শতাংশই কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। পথশিশুদের মধ্যে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার হারও তুলনামূলক বেশি।
মানুষ মানুষের জন্য। রাষ্ট্র সবার জন্য। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সব শ্রেণিপেশার মানুষের সুখ-শান্তি থাকা চাই। ধনী-গরিব অসহায় দরিদ্র সব মানুষ যেন অন্ততপক্ষে নাগরিক সুবিধা নিয়ে বাঁচতে পারে সেটা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। পথশিশুরা কি বাসস্থান বহির্ভূত থাকবে? যেহেতু বাংলাদেশে বৃহৎ একটি সমস্যা পথশিশু; সেহেতু সরকার কেন এর স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধান করছে না। ৫৩ বছরে যেই সমস্যার সমাধান হয়নি তার সমাধান আদৌ কি হবে? তাদের পুরোপুরি পুনর্বাসনের জন্য খুব বেশি উদ্যোগ নেই। শহরে অনেক বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ আছে এই পথশিশুদের জন্য। সরকারি কিছু উদ্যোগও আছে। কিন্তু এর কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়। এটা ঘায়ে মলম দেয়ার মতো। আসলে তাদের দরকার স্থায়ী পুনর্বাসন।
আমরা চাইলেই সব পারি। কিন্তু আমরা সেভাবে চিন্তা করি না। তাই, আসুন না আমরা সবাই পথশিশুদের প্রতি করুণভাবে না তাকিয়ে ওদের অধিকারের দিকে তাকাই। ওদের প্রাপ্য ওদের বুঝিয়ে দিই।
তাহলে আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পাবর।
ফারজানা ইসলাম : কবি ও সামাজিক উদ্যোক্তা