সংবিধানকে বলা হয় রাষ্ট্রের দর্পণ। কিংবা যে কোনো শাসন ব্যবস্থার মূল গ্রন্থ। নাগরিকদের অধিকার, কর্তব্য, শাসকদের ক্ষমতা, নাগরিকদের সঙ্গে শাসকবর্গের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ের স্পষ্ট চুক্তিপত্র। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংবিধান রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
যে কোনো দেশের সংবিধান সাধারণত সে দেশের সর্বস্তরের মানুষের অভিপ্রায়ের আলোকেই লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। সুষ্ঠু সমাজ পরিচালনার জন্যই মানুষ বিধিবদ্ধ কিছু আইন ও নিয়ম শৃঙ্খলার শরণাপন্ন হয়। রাষ্ট্র যেহেতু সমাজের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশা ও জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনেই রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই সব মানুষ স্ব স্ব অধিকার ও চাহিদা পূরণের জন্য নিজ নিজ রাষ্ট্রের মৌলিক চুক্তিপত্র তথা সংবিধানের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। আর সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় সুন্দর, গঠনমূলক ও রাষ্ট্রের সব মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি মৌলিক সংবিধান যে কোনো রাষ্ট্রের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামক নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান রচিত হয়েছিল রাষ্ট্রের সেই মৌলিক চুক্তিপত্রে বাঙালি জাতির ইচ্ছা অভিপ্রায় কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল সেটাই এখন দেখার বিষয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার এতগুলো বছর পর দেশে নতুন করে স্বৈরাচারের বেড়ে ওঠা ও জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া যেন প্রশ্নবিদ্ধ করছে আমাদের '৭২-এর সংবিধানকেই।
যদি সে সংবিধান যথাযথ সঠিক ও কার্যকর হয় তাহলে তা নিজেদের মতো পরিবর্তন পরিমার্জন করে কীভাবে জনগণের গাড়ে চেপে বসেছিল নতুন ফ্যাসিস্ট। আইনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার ফাঁকফোকর কী তাহলে সংবিধানেই আছে?
\হনয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মাত্র এক বছরের মাথায় একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেন তৎকালীন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। সংবিধানটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বটেই ১১টি অধ্যায়ে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিলে বিন্যস্ত এই সংবিধানে ওঠে এসেছে দেশের সর্বোচ্চ আইন, জনগণই যে সব ক্ষমতার মালিক, জনগণের অভিব্যক্তির প্রকাশই যে সংবিধান, প্রজাতন্ত্রের লক্ষ্য যে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত সংসদীয় সরকারই যে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে, বিচার বিভাগ যে স্বাধীন থাকবে- এর প্রায় সবই স্পষ্টভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে এ সংবিধানে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন, কর্মকমিশন, ন্যায়পাল ও মহাহিসাব-নিরীক্ষক ইত্যাদি যে সাংবিধানিক সংস্থা হবে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন যে বিচার বিভাগ বাতিল করতে পারবে- এ রকম অনেক মৌলিক প্রশ্নে রাষ্ট্র তার অবস্থানের কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে এ সংবিধানে।
কিন্তু মুশকিল হলো, সংবিধানটি নিবিড়ভাবে পাঠ করলে যে কারো চোখেই ধরা পড়বে যে, ওপরে যেসব অধিকারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে কার্যত সংবিধান এবং অপরাপর আইন যেন তার বিপরীত অবস্থান নেয় তার পথও এই সংবিধানে খুবই দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ এবং নির্ধারণ করা হয়েছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, এটি একটি গোলকধাঁধার মতো। 'প্রদত্ত' যে কোনো অধিকারের হাত ধরেই আপনি সংবিধানের ভেতরে প্রবেশ করুন না কেন, শেষতক সে আপনাকে পাকিস্তান বা আরও সত্য করে বললে পাকিস্তান ও ব্রিটিশ শাসনামলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, 'ক্ষমতা'র প্রশ্নটি; সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সংবিধান হলো জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি অর্থাৎ ইচ্ছার প্রতিফলন এবং এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা নাগরিকের 'পবিত্র দায়িত্ব' এবং সেই সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ৭(১) বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। লক্ষণীয়, বাক্যটি এখানে শেষ হয়নি, বাক্যের মধ্যে একটি' : 'চিহ্ন দিয়ে বলা হচ্ছে' এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ, কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে'। পুরো অনুচ্ছেদটি পাঠ করলেই বোঝা যায়, ক্ষমতার মালিকানা জনগণের হলেও প্রয়োগের মালিকানা নিয়ে কিছু নির্দেশনা আছে এবং তা এই সংবিধানেই দেওয়া আছে।
অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) এ বলা হচ্ছে যে, 'কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন'। তার মানে হলো সাধারণভাবে সংবিধান পাঠ করলে যে মনে হয় রাষ্ট্রপতি কোনো দন্ডপ্রাপ্ত আসামির দন্ড মওকুফ করে দিতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৪৯), তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক (অনুচ্ছেদ ৬১), তিনি প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগ দান করেন (অনুচ্ছেদ ৬৪ ও ৯৫), কিংবা তিনি নির্বাচন কমিশন (অনুচ্ছেদ ১১৮), মহাহিসাব নিরীক্ষক (অনুচ্ছেদ ১২৭) বা কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠা ও নিয়োগের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ১৩৭) তার কিছুই কার্যত স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে-
অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুযায়ী ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের যে ক্ষমতা দিয়েছে তাও আসলে কথার মারপঁ্যাচ। এ ক্ষমতাও তার নয়, এ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের। ৫৬(৩)-এ বলছে, 'যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।' এটুকু পড়লেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতাই সংবিধান রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ করেনি।
শুধু আজকের সংবিধান না। '৭২-এর সংবিধানেও যে খুব বেশি জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে বিষয়টা এমনটাও নয়।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা এমনই ছিল যে তারা নিজেদের অধিকার পূর্ণভাবে পায়। এবং অন্যায়ভাবে কেউ শাসন করতে না পারে। কিন্তু তা আর হলো কই। স্বাধীনতার এতটা বছর পরেও অধিকার বঞ্চিত থেকেই গেছে সাধারণ জনগণ।
এত গেল গুটি কয়েক বিষয়। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি বিষয়েই এমন সব কথার ম্যারপঁ্যাচ রাখা হয়েছে- যাতে খুব সহজেই নিজেদের মতো পরিবর্তন করা যায়- এই সংবিধান। যার কারণে খুব সহজেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত একেকজন হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর স্বৈরাচার। ভুলে যায় নির্বাচনী ইশতিহার। নতুন বাংলাদেশের কাছে এটাই প্রত্যাশা যে, সংবিধান সংস্কার বা পুনঃলিখন করা হোক। আর যেন কখনোই আমাদের কোনো স্বৈরশাসকের মুখ দেখতে না হয়। নিজেদের স্বার্থে সংবিধানকে কেউ ব্যবহার করতে না পারে।
মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম : কলাম লেখক