মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি

দেশের মানুষ তার স্বরূপটা বুঝে ফেলেছিল। তিনি জনবিচ্ছিন্ন এক ফ্যাসিবাদী সরকারের পরিণত হয়ে যান। দেশের সর্বত্র তার শাসনে বৈষম্য বিরাজ করতে থাকে। আর তখনই বৈষম্য নিরোধে ছাত্ররা মাঠে নামে। একটি বিশেষ পস্ন্যাট ফরম থেকে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয়। এই পস্ন্যাট ফরমটি ছিল একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পস্ন্যাট ফরম। দলে দলে ছাত্র-জনতা-শ্রমিক ফ্যাসিবাদী সরকার হাসিনার পতনে মাঠে নামে।

প্রকাশ | ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বিশ্ববিখ্যাত সাধক, মানবধর্ম প্রচারক, মানবতাবাদী গানের প্রণেতা, পৃথিবীর বিখ্যাত বাউল লালন শাহ বলেছেন, 'মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি- এই কথাটির মর্মাথ ক'জন বুঝতে পারেন। যদি এর ভাবার্থটুকু মানুষ বুঝত এবং মেনে চলত, তাহলে পৃথিবীতে পরশ্রীকাতরতা, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, খুনখারাবি, ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতাটা বন্ধ হয়ে যেত। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এই লাইনটুকু মেনে চলেই দেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়ে যেত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। '৭১-এর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হন ত্রিশ লাখ মানুষ, পাক হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারান দুই লাখ নারী। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশ হবে সাম্যের সুষম বণ্টন ব্যবস্থার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সর্বোপরি বাংলাদেশ হবে মানুষের বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তাতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথা উলেস্নখ থাকে। যা সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, দেশের শাসকগোষ্ঠী উলিস্নখিত বিষয়টি বাস্তবায়ন করেনি কোনো সময়। আজ স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বছর পরও মানুষ তার অধিকার পায়নি। শাসকশ্রেণি নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের ব্যস্ত থাকে। ফলে, মূল বা শেকড় থেকে সরে যেতে থাকে শাসকশ্রেণি। আর এই কারণেই ঘটে তাদের পতন। শাসকশ্রেণি মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যায়। তাই শাসকশ্র্রেণির শেকড় আর মাটি অর্থাৎ মানুষের মাঝে ধরে রাখতে পারে না। ফলে, শাসক নামক বৃক্ষটি ভূ-পাতিত হয়। ভূ-পাতিত হওয়ার পর তার নাম নিশানাটুকুই মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। এভাবেই '৭৫-এর পর বাংলাদেশের রাজনীতি আবার আসে নতুন সরকার। তবে এই সরকারটিও বেশি দিন টিকেনি, তাকে সরিয়ে সামরিক সরকার দেশে শাসনযন্ত্রটির স্টিয়ারিংটা ধরে। এটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম সামরিক সরকার আমল- যা '৭১-এর পর এমন সরকার আসবে তা মানুষ ভাবেনি। এই সরকার মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, প্রত্যাশা জাগায় মানুষের মনে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। মানুষ ভাবে ১৯৭১ সালের যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে, এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি হায়েনাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল, সেই স্বপ্নটা এই নতুন সরকার হয়তো পূরণ করবে তা সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করে। কারণ এই সরকার প্রধান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এই সরকারও তার নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য '৭১-এর বিরোধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়। মানুষ সংক্ষুব্ধ হয় সরকারের প্রতি। সরকারকে বিতাড়নে চেষ্টা চলে আন্দোলন সংগ্রাম। সাধারণ মানুষের সরকার বিতাড়নের চেষ্টার ফাঁকে আরেক সামরিক সরকার দেশের গদি দখল করে নেয়। সাধারণ মানুষ ভাবে হয়তো নতুন সরকার মানুষের চাওয়া পাওয়ার কথাটি বুঝবে এবং তা পূরণ করবে। শোষণহীন সাম্যের বাংলাদেশ হবে হয়তো এই সরকারের হাত ধরে। কারণ এই সরকার 'নতুন বাংলাদেশ গড়ব, মোরা নতুন করে আজ শপথ নিলাম' শিরোনামে স্স্নেস্নাগানটি দলের ভেতর ধারণ করে। কিন্তু বাস্তবে আগের দুই তিন সরকারের চেয়ে এই সরকারের দুর্নীতি আরও বেশি হয়ে যায়। ফলে, মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে সরকার তাড়াতে মাঠে নামে। দেশের ইতিহাসে গণতন্ত্রের কায়েমের জন্য এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তুলে ছাত্ররা। এরশাদ সরকার তার পুলিশ সেনাবাহিনী দিয়ে অসংখ্য ছাত্রকে হত্যা করে। ছাত্র মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দেয়। প্রাণ হারায় অগণিত ছাত্র। সারাদেশে বেহায়া এরশাদকে বিতাড়নের জন্য তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত আন্দোলন গড়ে ওঠে। মানুষ থেকে এরশাদ বিচ্ছিন্ন্ন হয়ে পড়ে। এরশাদ ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচন করে ১৯৮৮ সালে। এই নির্বাচনে একক এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এরশাদের দল। তাকে সাপোর্ট দিতে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে সাইনবোর্ডসর্বস্ব ৭০টি দল মিলে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) তৈরি করে। আ স ম আব্দুর রব হন বিরোধী দলীয় নেতা। কিন্তু মানুষ ছাড়া দল কি মূল আঁকড়ে মাটি ধরে রাখতে পারে? ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চাপে এরশাদ ও তার বিরোধীদলীয় নেতা আ স ম আব্দুর রবও তা ধরে রাখতে পারেনি। শিকড়সহ উপড়ে পরে এরশাদের দল অর্থাৎ এরশাদের পতন হয়। গণতন্ত্রের প্রত্যাশায় মানুষের বিজয় হয়। তৎকালীন আট দল, পাঁচ দল, সাত দল মিলে আগামী সময়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালানোর জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে। ১৯৯১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বেগম খালেদা জিয়া সরকারপ্রধান হন। দেশে পুনরায় চালু হয় সংসদীয় সরকার। বিএনপি ক্ষমতায় এসে পাঁচ দল, আট দল, সাত দলের তৈরি রূপরেখাটি ভুলে যায়। বিএনপিও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা চালায়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি ভোটারবিহীন একটি বিতর্কিত নির্বাচন করে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে বিএনপির সরকার সরে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে পুনরায় বিএনপির নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসে বিএনপি বিরোধী নিপীড়নে মাঠে নামে। ২০০১ সালে বিজয়ীরা এ দেশের হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। ১৩ বছর বয়সি হিন্দু ধর্ম পালনকারী এক কিশোরীর ওপর বিজয়ী দলের কর্মীরা এক এক করে ধর্ষণ করে। ২০০১ সালে বিএনপি টাকা পাচার, হাওয়া ভবন কান্ডসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মানুষের কথা তারা ভুলে যায়। ফলে, বিএনপির বিরুদ্ধে চলে দুর্বার আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে ক্ষমতায় আসে কথিত ওয়ান ইলিভেনের সরকার। এই সরকারও নানা অপরাধ করে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের অঙ্গীকার করে নির্র্বাচন করে। ২০০৮ সালের নির্র্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে। তারা ক্ষমতায় বসার পর নির্র্বাচনী প্রতিশ্রম্নতিগুলো ভুলে যায়। প্রকৃত ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতারা ক্রমে ক্রমে দলীয় পদ হারাতে থাকে। ২০১৩ সালে নজিরবিহীন ভোট ছাড়া নির্বাচনে নিজেদের ক্ষমতায় নিয়ে আসে এই আওয়ামী লীগ, এ ধরনের নির্বাচন করে ২০১৮ ও ২০২৪-এ। নানা ধরনের আইন তৈরি করে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বারোটা বাজায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা হয়ে যান এক স্বৈরনায়ক। তিনি নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার দরকার সবকিছুই করেন। দেশের মানুষের কথা তিনি ভাবেননি। তিনি শুধু ভেবেছেন তার ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার কথা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের মাঝে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এই হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করতে পেরেছেন তার কন্যা হিসেবে। কিন্তু মানুষ তার এই কুমীরের কান্নাকে বুঝে ফেলেছিল। তিনি জাতির জনককে তার কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করায় জাতির জনককে বির্তকিত করে ফেলে দিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে তিনি করেছেন ভূলুণ্ঠিত। মুখে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন একদিকে; অন্যদিকে, তিনি হয়ে গেছেন কওমি মাদার। এই ধরনের দ্বি-নৈতিকতার কারণে তিনি জনবিচ্ছিন্ন শাসকের পরিণত হন। তেঁতুল হুজুর ও মামুনুল হককে তিনি কাছে টেনেছেন ক্ষমতায় থাকার জন্য, আবার তিনিই বলেছেন, তিনি অসাম্প্রদায়িক শাসক। পাঁচশত মডেল মসজিদ তৈরি করেছেন, এই মসজিদগুলোতে চর্চা হয় ইসলামী সংস্কৃতির, আবার এই শেখ হাসিনাই বলতেন জামায়াত সাম্প্রদায়িক দল তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তিনি জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করেন। \হদেশের মানুষ তার স্বরূপটা বুঝে ফেলেছিল। তিনি জনবিচ্ছিন্ন এক ফ্যাসিবাদী সরকারের পরিণত হয়ে যান। দেশের সর্বত্র তার শাসনে বৈষম্য বিরাজ করতে থাকে। আর তখনই বৈষম্য নিরোধে ছাত্ররা মাঠে নামে। একটি বিশেষ পস্ন্যাট ফরম থেকে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয়। এই পস্ন্যাট ফরমটি ছিল একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পস্ন্যাট ফরম। দলে দলে ছাত্র-জনতা-শ্রমিক ফ্যাসিবাদী সরকার হাসিনার পতনে মাঠে নামে। লাখ লাখ জনতার আন্দোলনে মুখে দুপুরের আহার না করেই ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণভবনের একটি গোপন দরজা দিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়। হাসিনা পলায়নের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকারেও দেখা যাচ্ছে যে, তারাও আন্দোলনের মূল স্র্রোত থেকে সরে আসছে। এই সরকারটির নেপথ্য নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে জামায়াত-বিএনপি। হাসিনার ন্যায় এরাও নিজেদের বাইরে কোনো বিরোধীদের মতামত বা মন্তব্যকে সহ্য করতে পারছে না। সম্প্রতি তারা হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম দল সিপিবির রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধের জন্য এরা আদালতে একটি রিট করে। যদিও এই রিটটি তারা আদালত থেকে উঠিয়ে নেয় ভুল বুঝতে পেরে। কেন এই কাজটি তারা করল? তারা কি জেনে বুঝে এই কাজটি করেছে? পরে বুঝতে পারল- এর ফলে, তারা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছে। তাই হয়ত তারা এই রিটটা তুলে নিল। হিজবুত তাহরীরের আর্দশিকতা ও জামায়াতের একটি প্রভাবের গন্ধ এই সরকারের মাঝে কিছুটা পরিলক্ষিত হচ্ছে- যা জাতির জন্য শুভ নয়। মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কোনো সরকারই টিকতে পারে না। বাংলা জনপদটি আদিকাল থেকে অসাম্প্রদায়িক। এই জনপদে কোনো শাসকই মৌলবাদী চেতনার আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা করে টিকে থাকতে পারেনি। যেহেতু এই জনপদটির মানুষ অসাম্প্রদায়িক তাই এখানে মৌলবাদী চেতনার সরকার স্থাপনের চেষ্টা করলে মানুষ থেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে আর তখনই মূল শেকড়টা মাটি থেকে ওঠে যাবে এবং গাছটি (সরকার) ভূপাতিত হয়ে পড়বে মাটিতে। তাই যে কেউ, সরকারের আসুন না কেন, লালনের এই বিখ্যাত উক্তিটি লালন করে দেশ চালান। নইলে এই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন না বেশি দিন। এই কথাটি মনে রাখবেন। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক